মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »
ট্রেনের ডিজিটাল ইঞ্জিন আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী রেলপথকে সক্ষম করা হয়নি। তাই অক্ষমতার রেলপথে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে ডিজিটাল ইঞ্জিনযুক্ত ট্রেন। বিকল হয়ে যাওয়া ট্রেন ইঞ্জিনের ত্রুটি মনিটরে দেখালেও তা কোনো কাজে আসছে না।
এদিকে রেলমন্ত্রী ইলেকট্রিক ট্রেনের বুলি দিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। কারণ সিডিউল কোচের ট্রেন নিয়ে ডিজিটাল ইঞ্জিন চলার ক্ষমতা নেই। ৭০/৮০ কিলোমিটার গতি উঠলেই কাঁপতে থাকে কোচগুলো।
লোকোমাস্টাররা বলছেন অন্যকথা। তারা বলেন, অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। অত্যাধুনিক কোচ আর ইঞ্জিন ডিজিটাল হলে কি হবে ট্র্যাক ঠিক না করা পর্যন্ত সুফল মিলবে না ডিজিটালাইজড লোকোমোটিভসের।
আরও জানা গেছে, যদিও ইঞ্জিনের গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। কিন্তু বাংলাদেশের রেল লাইনের ক্ষমতানুযায়ী সর্বোচ্চ ৯০ কিলোমিটার গতিবেগ সেট করা হয়েছে। চালানো হবে ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৮৫কিলোমিটার গতিবেগে।
উন্নয়নের গতি ধারায় এখানে উল্লেখ্য, এর আগে গত জুন পর্যন্ত এসেছে ২০০ ইন্দোনেশিয়ান কোচ। সম্প্রতি ভারত থেকে এসেছে ১০টি ব্রডগেজ ট্রেনের ইঞ্জিন। ২০১৮ সালে ১০০টি মিটারগেজ ও ৫০টি ইন্দোনেশিয়ান কোচ যুক্ত হয়েছে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে। ডিজিটাল পদ্ধতির এসব ইঞ্জিনের কেবিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত না হলেও ট্রাকশন মোটরগুলো সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
পাহাড়তলীস্থ ডিজেল সপে কোরিয়ার হুন্দাই রোটেন কোম্পানির ও আমেরিকা থেকে আসা প্রকৌশলীরা দ্রুততার সঙ্গে এসব ইঞ্জিনের কমিশনিং শেষ করে বিভিন্ন ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত করা করেছে। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ট্রেনে যাত্রী সেবার মান বেড়েছে শতভাগ।
প্রধানমন্ত্রীর নজরদারীতে চলছে রেলের আড়াই লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন। ধাপে ধাপে উন্নয়ন হচ্ছে ২০ বছরের পরিকল্পনার অংশ। পূর্বাঞ্চলের রেলপথে ডিসেম্বরের শুরুতেই নামছে ৪০০ কোটি টাকায় কোরিয়া থেকে আনা মিটারগেজ ১০টি ডিজিটাল লোকোমোটিভ (ট্রেন ইঞ্জিন)। দুই হাজার হর্স পাওয়ারের এসব ইঞ্জিন সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজড। হঠাৎ ইঞ্জিনের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলে মনিটরে দেখাবে ইঞ্জিনের কোথায় এবং কী ত্রুটির কারণে থেমে গেল।
ডিজিটাল ট্রেন ইঞ্জিন প্রসঙ্গে কোরিয়ান এক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, লুব ওয়েলের কনজাম্পশন ঠিক আছে কিনা, র্স্টাটিং সিস্টেম ঠিক আছে কিনা, ডিজিটাল মনিটরে তা প্রদর্শন করছে কিনা, ইঞ্জিনের ত্রুটি থাকলে র্স্টাটিং কোন পয়েন্টে ত্রুটি ইঞ্জিনের ভেতরে থাকা মনিটরে তা দেখাচ্ছে কিনা, ট্রাকশন মটরের এসি কাজ করছে কিনা, সবকিছু ইঞ্জিন কমিশনিংয়ের সময় এসব বিষয়
প্রত্যক্ষভাবে দেখা হয়। ইঞ্জিনের সঙ্গে থাকা অয়েল ট্যাংকের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী অয়েল রিজার্ভ করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করা হয়।
ট্রেন ইঞ্জিনের কমিশনিং ও লাইট এবং লোড ট্রায়াল প্রসঙ্গে ওয়ার্কস ম্যানেজার (ডিজেল) বাংলাধারাকে বলেন, এসব ইঞ্জিন সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজড। ২০০০ হর্স পাওয়ার বিশিষ্ট এসব ইঞ্জিন অটোমেটিক কন্ট্রোল সিস্টেমের। ইঞ্জিনের বিভিন্ন প্যারামিটারগুলো ডিজিটাল মনিটরে দেখা যাবে। এসব ইঞ্জিনে কোন ডেডম্যান প্যাডেল নেই ফলে লোকোমাস্টার ইঞ্জিনের কেবিনের ভেতরে
ঘুমানোরও কোন সুযোগ নেই। ইঞ্জিনের সামনে স্যান্ডিং সিস্টেম ও ক্যাটেল গার্ডও রয়েছে। যদিও ইঞ্জিনের গতিবেগ ঘন্টায় ১১০ কিলোমিটার কিন্তু আমাদের লাইনের ক্ষমতানুযায়ী সর্বোচ্চ ৯০ কিলোমিটার গতিবেগ সেট করা হয়েছে। এরপরও ৮০/৮৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে থাকলে এ্যালার্ম বাজবে। এতেও চালক গতি কন্ট্রোল না করলে ইঞ্জিন অটোমেটিক থেমে যাবে।
বাংলাদেশ রেলওয়েতে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে মিটারগেজ (এমজি) লাইনে ট্রেন চলাচলের জন্য ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি কোরিয়ান ডিজেল ইলেকট্রিক ইঞ্জিন ক্রয় করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৭ মে এসব মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক ইঞ্জিন ক্রয়ের জন্য কোরিয়ার হুন্দাই রোটেন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (প্রকল্প) এসব লোকোমোটিভ গতমাসে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস করে পাহাড়তলীস্থ ডিজেলসপে পাঠানো হয়েছে।
আরও জানা যায়, কোরিয়া থেকে ৬ সদস্য এবং আমেরিকা থেকে দুজনসহ ৮ জনের প্রকৌশলী দলটি চট্টগ্রাম পৌছে ইঞ্জিনের কমিশনিং করে গেছেন ২০২০ সালের অক্টোবরে। প্রতিটি ইঞ্জিন কমিশনিংয়ে কমপক্ষে ৭/৮ দিন সময় লেগেছে। এরপর প্রতিটি ইঞ্জিন পাহাড়তলী ডিজেলসপ থেকে চিনকি আস্তানা স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার লাইট ট্রায়াল শেষ করেছে। লাইট ট্রায়ালের পর ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজারের (ডিআরএম) তত্বাবধানে লোড ট্রায়াল শেষ করেছে। এগুলো লোড নিয়ে লাকমাস স্টেশন পর্যন্ত গেছে প্রায় ৮০ কিলোমিটার বেগে। শতভাগ পরিপূর্ণতায় ইঞ্জিনগুলো যাত্রীবাহী আন্তঃনগর ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বলে রেলের মহাপরিচালকের দফতর সূত্রে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে ল্যান্ডিং খরচসহ প্রায় ৪০০ কোটি টাকায় এ ১০টি লোকোমোটিভ ক্রয় করা হয়েছে বলে চীফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নুর আহমেদ (প্রজেক্ট) এর পক্ষ থেকে জানা গেছে।
কোরিয়ান হুন্দাই রোটেন কোম্পানির পক্ষ থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৭ মে ১০টি ডিজেল ইলেকট্রিক (ডিই) লোকোমোটিভ ক্রয়ের জন্য চুক্তি হয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে। এডিবির অর্থায়নে বাংলাদেশ রেলওয়ে এসব লোকোমোটিভস সংগ্রহ করেছে। এ প্রকল্পের ডিরেক্টর ইঞ্জিনগুলো ক্রয় থেকে শুরু করে সরবরাহ পর্যন্ত কয়েকদফায় পরিদর্শন করেছেন কোরিয়াতে। ৮৭ হাজার ৬৫০ কেজি ওজনের এসব লোকোমোটিভসের ক্ষমতা ২০০০ হর্স পাওয়ার।
বাংলাদেশে এই প্রথম ৫০০ হর্স পাওয়ার অতিরিক্ত ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল ইঞ্জিন মিটারগেজ লাইনে চলার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এসব ইঞ্জিন লিফটিং এবং প্যাকিং ইনস্ট্রাকশনও কোরিয়ান হুন্দাই রোটেন কোম্পানির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও যদি কোন ধরনের সমস্যা থাকে তা এ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য প্রকল্প পরিচালককে বলা হয়েছে।
রেল ভবনস্থ প্রধান প্রকৌশলী (প্রকল্প) পরিচালকের দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি লোকোমোটিভ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করার সময় ডিউটি, ভ্যাটসহ আরও প্রায় ৩০ শতাংশ তথা ৯ কোটি টাকা
এবং আনুষঙ্গিক ডেলিভারি চার্জসহ প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে পাহাড়তলীস্থ ডিজেলসপ পর্যন্ত। ফলে ১০টি ইঞ্জিন ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ডিজিটাল পদ্ধতির এসব লোকোমোটিভসের অপারেটিং সিস্টেম বুঝিয়ে
দিয়ে কমিশনিং শেষে লাইট ও লোড ট্রায়ালে পাঠানো হবে।
১০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন এসব লোকোমোটিভসের লোড ট্রায়াল চলবে সর্বোচ্চ ৮০/৮৫ কিলোমিটার গতিতে। কোরিয়া থেকে ক্রয় ও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ইঞ্জিনে ৪০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ১০টি লোকোমোটিভস কমিশনিং শেষে ট্রেনে কোচ কম্পোজিশন অনুযায়ী ১৮/৩৬ তথা ১৮টি কোচ বা তার কমবেশি ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।