শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত»
ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন। শনিবার রাত সাড়ে ৯ টায় ১৫ সদস্যের দল নিয়ে ভাটিয়ারীর বিএম কন্টেইনার ডিপোতে যোগ দেন স্টেশন মাস্টার সুলতান মাহমুদ। প্রায় ২ শতাধিক মানুষের জীবন অগ্নিকুন্ডে সংকটাপন্ন তাই সাইরেন বাজিয়ে তারা দ্রুত গতিতে ছুটে যান দমকল বাহিনীর সদস্যরা। এর কিছুক্ষণ পর সেখানে যোগ দেন সীতাকুন্ড ফায়ার সার্ভিসের আরো ১১ সদস্য। তবে আগুন নেভানোর আগে নিভে যায় ৯ দমকল কর্মীর জীবন প্রদীপ।
ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় স্বাভাবিকভাবে পানি ছিঁটাতে থাকেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। তবে রাত সাড়ে দশটার পরে কন্টেইনারে থাকা রাসায়নিক পর্দাথ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কারণে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এরপর আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই হিংস্র হতে থাকে। একের পর এক বিস্ফোরণে কেপেঁ ওঠে আশপাশের প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকা। রাত তিনটার পরে আগুনে নিয়ন্ত্রণে না আসায় ফেনী,লক্ষীপুর এবং কুমিল্লা থেকে যুক্ত আরো বেশ কয়েকটি ইউনিট। ২৫ ঘন্টা ব্যবধানে ফায়ার সার্ভিসের ২৫ টি ইউনিটের চেষ্টার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও এখনো জ্বলছে বিএম কন্টেইনার ডিপো।
ঘটনাস্থলে প্রথমে যোগ দেওয়া কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের ৬ জনই মারা যান প্রথম বিস্ফোরণে। ১৫ সদস্যের এই টিমে শাহাদাতবরণকারীরা হলেন কুমিরা ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার রানা মিয়া, আলাউদ্দিন, শাকিল তরফদার, নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট মনিরুজ্জামান, লিডার মিঠু দেওয়ান।তবে সম্পূর্ণ অক্ষত থাকেন ওই টিমের একজন। তবে এখনো শনাক্ত হয়নি কুমিরা ফায়ার স্টেশনের লিডার ইমরান হোসেন মজুমদার, ফায়ার ফাইটার শফিউল ইসলাম এর লাশ। ঘটনাস্থলে যোগ দেওয়া সীতাকুন্ড ফায়ার সার্ভিসের ১১ সদস্যের তিন সদস্য স্টেশনের লিডার নিপুন চাকমা, ফায়ার ফাইটার রমজানুল ইসলাম ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও জীবন উৎসর্গ করেন কন্টেইনার ডিপোর মানুষগুলোকে বাচাঁতে। ওই স্টেশনের রবিউল ইসলাম ও ফরিদুজ্জামান নামে আরো দুই দমকল কর্মীর লাশ শনাক্ত হয়নি এখনো।
জীবনের শেষদিনটি কর্মস্থলে থেকে মানুষের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করে দেন এই ৯ দমকলকর্মী। কারো ছেলে,কারো স্বামী আবারো কারো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তারা। চট্টগ্রাম মেডিকেলে মর্গে নিখোঁজ এসব দমকল কর্মীদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠেছে পরিবেশ।বিভীষিকাময় এক রাতে এক সাথে প্রাণ সর্বোচ্চ এতজন দমকল কর্মী। বিগত চার দশকে দেশে আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ জন। যেখানে দেশের ইতিহাসে প্রথম একসাথে ৯ জন দমকল কর্মী প্রাণ হারান।সবশেষ ২০০৮ সালে একসাথে তিনজন ফায়ারম্যানের মৃত্যু হয়েছিলো।
কুমিরা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান মাহের উদ্দিন জানান,সবাই একসাথে দায়িত্ব এবং মানবিকতার টানে ঘটনাস্থলে ছুটে গেলেও ফিরে আসা কারো হয় নি স্টেশনে।আমাদের স্টেশনের ৬ জন কর্মী নিহত হন আগুন নিভাতে গিয়ে। নিখোঁজ রয়েছেন কয়েকজন। বাকিরা রয়েছেন ঢাকা এবং চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কর্মরত গাউসিয়া কমিটির সেচ্ছাসেবক সাকিব জানান, ফায়ার সাভির্স কর্মীদের অনেকের চেহারা এতটাই বিভৎস ছিলো বুঝার কিংবা দেখার কোনো উপায় নেই। আমি রীতিমতো জ্ঞান হারানোর অবস্থায় ছিলাম।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন গণমাধ্যকে জানান, দেশের ইতিহাসে এই প্রথম ৯ জন অগ্নিনির্বাপক কর্মী একসাথে মৃত্যুবরণ করেছেন চট্টগ্রামের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে। এছাড়া গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২৮ জন ফায়ার ফাইটার কর্মী।
ইহকালের নশ্বর পৃথিবী থেকে জীবনের ফানুস উড়ে যাবে পরকালে।সে জীবনটা যদি উৎসর্গ করা যায় মানুষের তরে তাহলে জীবনের স্বার্থকতার আর কি বাকি থাকে। আর তাই আগুন নিভাতে গিয়ে এবং সে আগুন নিভার আগে নিভে গেলো ৯ ফায়ার ফাইটারের জীবন।