টানা এক সপ্তাহ ধরে থেমে থেমে ভারী বর্ষণ চলছে কক্সবাজারে। এতে, পাহাড় ধসের আশংকা করছে আবহাওয়া অফিস। বৃষ্টি চলমান থাকলে- পাহাড় ও তার পাদদেশে ঝুঁকিতে বাস করা বসতির বাসিন্দারা ধ্বসের মাটি চাপায় মৃত্যুর মিছিলে সামিল হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। তাই কক্সবাজার শহরের কলাতলী, ঘোনাপাড়া, পাহাড়তলী, বাদশা ঘোনা, আদর্শগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ে এবং পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে গত শুক্রবার হতে মাইকিং করেছে জেলা প্রশাসন।
মাইকিংয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার আহবান জানানো হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট, সিপিপি, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা উপস্থিততে এ আহবান জানালেও কেউ কর্ণপাত করছে না।
আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারি আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান জানান, মৌসুমি লঘুচাপের কারণে দেশে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। কক্সবাজারেও রয়েছে এর প্রভাব। শনিবার ১২০, রবিবার ৮১ এবং সোমবার ৯২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে কক্সবাজারে। আগামী ৫ জুলাই পর্যন্ত মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এসময় পাহাড় ধ্বসসহ নানা দূর্যোগ ঘটতে পারে। জেলায় দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে।
সূত্র মতে, কক্সবাজার সদর ও বাকি উপজেলা, রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং জেলার সীমান্তবর্তী পাশের এলাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিতে বাস করছে প্রায় তিন লাখাধিক মানুষ। এভাবে বাস করতে গিয়ে পাহাড় ধসে মাটিচাপায় গত দশ বছরে নারী-শিশুসহ অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এসব এলাকায় বসবাসরতদের সরাতে শুষ্কমৌসুমে কোন উদ্যোগ নেয়া না হলেও বর্ষায় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলেই দৌড়ঝাঁপ বাড়ে প্রশাসনের, এমন অভিযোগ ওয়াকিবহাল মানুষের। প্রতিবছরের ন্যায় এবারো ভারীবর্ষণ শুরুর পর ঝুঁকিতে বাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে মাইকিং করছে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এ পর্যন্ত কেউ ঝুঁকি ছেড়ে নিরাপদে যাবার খবর পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ গত ২১ জুন (শুক্রবার) ভোররাতে পাহাড় ধসে কক্সবাজার শহরের বাদশাহঘোনায় স্বামী-স্ত্রীর করুণ মৃত্যু হয়। পাহাড় কাটা বন্ধ করা না গেলে ঝুঁকিতে বাসকারীর সংখ্যা যেমন বাড়বে তেমনি পাহাড় ধসে মৃত্যুর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
কক্সবাজার জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্র মতে, ২০১৫ সাল হতে চলতি বছর পর্যন্ত সময়ে পাহাড় ধসে কক্সবাজারে ৫২ জনের করুণ মৃত্যু হয়েছে। তৎমধ্যে ২০১৫ সালে ৫ জন, ২০১৬ সালে ৫ জন, ২০১৭ সালে ৪ জন, ২০১৮ সালে ৫ জন, ২০১৯ সালে ৪ জন, ২০২১ সালে ১২ জন, ২০২২ সালে ৫জন। চলতি মাসের ১৯ জুন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং ২১ জুন কক্সবাজার শহরের বাদশাহ ঘোনায় পাহাড় ধসের ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু হয়। তবে, ২০২০ ও ২৩ সালে পাহাড় ধসে কতজন মারা গেছেন এমন কোন তথ্য জেলা প্রশাসনে সংরক্ষিত নেই। আর চলতি বছরের এ সময় পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যু রেকর্ড করেছে তারা। সে হিসেবে গত ৯ বছরে ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কক্সবাজার বন বিভাগ সূত্র মতে, চলতি সময় পর্যন্ত জেলায় ৪৭ হাজার ৯১৪ দখলদারের হাতে ধ্বংস হয়েছে ২৫ হাজার ৭ দশমিক ৬৯ একর বনভূমি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, চকরিয়া, রামু, ঈদগাঁও, উখিয়া, টেকনাফ, পেকুয়া এবং মহেশখালীতেও পাহাড় কেটে ঝুঁকিতে বসবাস বাড়ছে। একইভাবে বাস গাড়ছে নাইক্যংছড়ির দোছড়ি, বাইশারীসহ আশপাশের এলাকায়। তবে, কক্সআাজারে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে বাস রয়েছে কক্সবাজার পৌরসভার পাঁচটি ওয়ার্ডে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা সভাপতি সাংবাদিক এইচ এম এরশাদ বলেন, প্রতি বছর জেলায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও ঝুঁকি নিয়ে বাসরতদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার তোড়জোড় শুধু বর্ষা এলেই শুরু হয়। তাও কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে। শুষ্কমৌসুমে আর কোন কার্যক্রম চোখে পড়েনা। ফলে অনেকটা বাধাহীনভাবে পাহাড় নিধন করে টাকার বিনিময়ে বসতির ব্যবস্থা করে দেয় প্রভাবশালীরা। এতে পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি অনাকাংখিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তাই পাহাড় কাটা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া এ দায় এড়ানো অসম্ভব।
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, জেলার পাহাড় ও ইসিএ সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন হলে প্রতিবছর প্রাণহাণি এড়ানো যেত। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা নিজ দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করছে বলে মনে হয় না।
তবে, বরাবরের মতোই পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে বলে দাবি করে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আতাউল গনি ওসমানী বলেন, পাহাড়ে ঝুঁকিতে বসতি করাদের স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেয়া একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রসেস। এরপরও ঝুঁকি এড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এসংক্রান্ত বেশ কয়েকটি সভায় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের প্রধান করে উপকমিটিও গঠন করা হয়। গত শুক্রবার (২৮ জুন) হতে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানান, নিজেরা সচেতন না হলে ঝুঁকি এড়ানো কঠিন। প্রতিবেশ রক্ষায় পাহাড় কাটা এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাস বন্ধ করতে জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। পাহাড় ধ্বস রোধে বেশি করে গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন ডিসি।