বৈশাখের খরতাপে দেশব্যাপী বাড়ছে গরমের তিব্রতা। পর্যটন জেলা কক্সবাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। ফলে গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সুপেয় পানির সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের পাশাপাশি অতিমাত্রায় ভূ-গর্ভের পানি উত্তোলনে কক্সবাজারে দিন দিন পানির স্তর নিচে নামছে। অনেক পাড়ার নলকূপে পানি উঠা বন্ধ হয়েছে। পানি উঠছে না বৈদ্যুতিক মোটরেও। পানির জন্য গ্রামের পর পর গ্রামে লোকজনের মাঝে হাহাকার চলছে। যে পাড়ার নলকূপে পানি উঠছে, সেখানে দূরদুরান্ত থেকে এসে লাইন ধরে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন পাড়ালিয়ারা।
পানি নিচে নেমে যাকার পাশাপাশি বাড়ছে ভূ-গর্ভস্থলে লবণাক্ততাও। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ইকোসিস্টেমের উপর প্রভাব পড়ছে চরম।
এ অবস্থা চলতে থাকলে পানিতে ই-কোলাই ভাইরাস বৃদ্ধি পেয়ে পানিবাহীত রোগব্যাধী বাড়তে পারে। সংকটে পড়তে পারে পর্যটন শিল্পও। ব্যাহত হতে পারে স্থানীয়দের স্বাভাবিক জীবনযাপন। এ অবস্থায় সুপেয় পানি সংকট সমাধানের পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।
সুপেয় পানি সংকট উদ্বেগজনক জানিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে কক্সবাজারে সুপেয় পানি সংকট মোকাবিলায় কাজ করছে তারা।
কক্সবাজারের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুল হান্নান বলেন, সোমবার (২২ এপ্রিল) কক্সবাজারে তাপমাত্র রেকর্ড করা হয়েছে ৩৪ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয় সূত্র মতে, ২০১৭ সালে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জরুরি ভিত্তিতে পানি সরবরাহ করতে বিভিন্ন ক্যাম্পে ৩ হাজার অগভীর, ৮০ টি গভীর এবং এনজিও সংস্থা আরও ২০০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করে। প্রতিদিন রোহিঙ্গা এবং স্থানীয়দের জন্য ৩০ লাখ লিটার পানি উত্তোলণ করা হচ্ছে শুধু দুই উপজেলায়। অতিমাত্রায় পানি উত্তোলন ও তিব্র গরমের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসানো অগভীর নলকূপের ৯০ ভাগ থেকে এখন পানি উত্তোলন হচ্ছেনা।
তথ্য মতে, টেকনাফের হ্নীলা, টেকনাফ সদর, বাহারছড়া, সাবরাং, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লেদা, দমদমিয়া এলাকায় সবচেয়ে বেশি সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এরসাথে যোগ হয়েছে লবণাক্ততা। উখিয়াতে তিব্রতা দেখা না দিলেও দিন দিন পানির স্তর নীচে নামছে। কক্সবাজারের ঈদগাঁও সদর, পোকখালী, গোমাতলী, ইসলামপুরের অনেক নলকূপে পানি উঠছে না। অকেজো হয়ে গেছে অনেক বৈদ্যুতিক মোটরও। কক্সবাজার শহরের নুরপাড়া, মাঝিরঘট, টেকপাড়া, নতুন বাহারছড়া, বদরমোকামসহ বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। অনেক স্থানের পানি খাওয়া তো দুরের কথা, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারও করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সার্ফেস ওয়াটারের দিকে জোর দেয়ার পরামর্শ সচেতন মহলের।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সাবেক সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে ধ্বংস করা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর বনভূমি। একই সাথে প্রতিদিন ভূ-গর্ভস্থ থেকে যে পরিমান পানি উত্তোলন করা হচ্ছে অদুর ভবিষ্যতে মাটির নিচে সুপেয় পানি পাওয়া যাবেনা। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি হওয়ায় বাড়ছে লবনাক্ততা। এখান থেকে রক্ষা পেতে হলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।
ঈদগাঁও স্কুল শিক্ষক একেএম জাহাঙ্গীর জানান, উপজেলার ৫ ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকা এবং পাহাড় বেষ্টিত গ্রাম গুলোতে সুপেয় পানীর অভাব দেখা দিয়েছে। নলকূপ অকেজো হওয়ার পাশাপাশি অকেজো হয়ে গেছে অনেক বৈদ্যুতিক মোটরও।
একইভাবে পানি সংকট চলছে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সোনাদিয়া দ্বীপেও দেখা দিয়েছে। পুরো সুষ্ক মৌসুম জুড়ে এটি চলমান থাকতে পারে বলে পূর্বঅভিজ্ঞতা থেকে শংকা প্রকাশ করছেন দ্বীপের বাসিন্দারা।
কক্সবাজারের সাবেক সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) রামু উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়া বলেন, পানিতে লবণাক্ততা বাড়লে, পান অযোগ্য পানিতে ই-কোলাই ভাইরাস বৃদ্ধি পেতে পারে। ই-কোলাই ভাইরাস বায়বীয় ও অবায়বীয় দুই অবস্থাতেই থাকতে পারে। এ ভাইরাসের কারণে মূত্রনালীতে সংক্রমণ, রক্তে বিষক্রিয়া, মেনিনজাইটিস টাইফয়েড, ডায়রিয়া, বমি এবং রক্তযুক্ত মল, মূত্রত্যাগের সময় ব্যথা, প্রস্রাবে দুর্গন্ধ এবং প্রচন্ড জ্বর হতে পারে।
কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সুপেয় পানি সংকট দুর করতে রেইন ওয়েটার হার্ভেস্টিং প্রকল্প চলমান রয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া-টেকনাফকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে উখিয়ার পালংখালীতে ৬০০ একর জমি লীজ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, টেকনাফ- উখিয়া এবং কক্সবাজার শহর ও উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির তিব্র সংকট দেখা দিতে পারে এমন শঙ্কায় ওয়াটার-এনার্জি-লাইভলিহোড (ওয়েল) নামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়াও চলমান রয়েছে রেইন ওয়ার্টার হার্ভেস্টিং প্রকল্প। সব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সুপেয় পানি সংকট দুর হবে। একই সাথে সাগরের লবনাক্ত পানি পরিশোধন করে কিভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়েও পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।