কক্সবাজারে ডেঙ্গু ভয়াবহতা বাড়ছে। গত তিনমাস ধরে এ রোগের বিস্তার কেবল বেড়েই চলেছে। চলতি মাসের এ সময় পর্যন্ত জেলায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার জনে। এরমধ্যে রোহিঙ্গা রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৫৮৫ জন এবং স্থানীয় রোগী প্রায় তিন হাজার জন। এ পর্যন্ত ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, আর মারা যাওয়া সবাই রোহিঙ্গা নাগরিক।
জেলা সদর হাসপাতাল সূত্র মতে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসে বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫১১ জন। এদের মাঝে ২৮০ জন পুরুষ (শিশু ৩৯ জন) আর ২৩১ জন নারী (২৮ শিশু)। আর ১৮ সেপ্টেম্বর ১০ শিশুসহ ৬৮ জন ডেঙ্গু রোগী কক্সবাজার সদর হাসপাতালে অবস্থান করছেন। এদের মাঝে মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) ভর্তি হয়েছেন ৩৯ জন। যাদের মাঝে ৭জনই শিশু। রয়েছে তিনজন রোহিঙ্গাও।
হাসপাতাল সূত্র আরো জানায়, গত জুলাই মাসে ২১৫ পুরুষ ও ৯৮ জন নারীসহ ৩১৩ জন ডেঙ্গু রোগী কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এদের মাঝে ৩৪ জন ছিলেন রোহিঙ্গা। আর চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজন নারী-পুরুষ রোহিঙ্গা মৃত্যুবরণ করেন। আর আগস্ট মাসে ৫৯৮ পুরুষ ও ৪০১ জন নারীসহ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন ৯৯৯ জন। এদের মাঝে ৮০ জন ছিলেন মিয়ানমার নাগরিক। তাদের মাঝে রোহিঙ্গা দু’নারী মারা যান। সে হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে তিন গুণের বেশি। আর চলতি মাসেই এ রোগের পরিসংখ্যান আরো আশ্চর্য্যজনক।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের মতে, গত আগস্ট মাস হতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। একে ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবেই ধরা হয়ে আসছে। আগস্ট মাসের শুরুতে সরকার পতনের পর পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডে ঠিকমতো ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে না। পাশাপাশি বৃষ্টির সময় নালা-নর্দমায় জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস মশার বংশবিস্তার ঘটছে। বর্ষণের কারণে শহরের অনেক স্থানে এখনো পানি জমে আছে। সেখানে এডিস মশা বংশবিস্তার করছে।
কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র মতে, জেলায় গত জুন মাসে ৩৩৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। এরমধ্যে স্থানীয় ৫৫ জন এবং রোহিঙ্গা ২৭৯ জন। জুলাই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৯৬৫ জন, এরমধ্যে স্থানীয় ৪৮৫ জন এবং রোহিঙ্গা ৪৮০ জন। আগস্ট মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আগস্ট মাসে ৪ হাজার ২৪৭ জন ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হয়। এরমধ্যে এক হাজার ৪৪৮ জন স্থানীয় এবং ২ হাজার ৭৯৯ জন রোহিঙ্গা। গত তিন মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু বরণ করেছে ৫ জন রোহিঙ্গা। সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আসিফ আহমদ হাওলাদার কক্সবাজারে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা প্রতিরোধে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বুধবার বিকেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, হাসপাতালে জরুরি বিভাগসহ ১৫টি ওয়ার্ডে মঙ্গলবার ভর্তি ছিলেন সাড়ে ৭শ’ জন। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় দেড়হাজার জন। আর হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন ৬৮ জন রোগী। এর মধ্যে শিশু ১০ ও নারী ৩২ জন। বেশির ভাগ রোগী শহরের পাহাড়তলী, আদর্শগ্রাম, কলাতলী, লারপাড়া, ঘোনাপাড়া, বৈদ্যঘোনাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে এসেছেন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শহরের ঘোনাপাড়ার বাসিন্দা আবিদুল ইসলাম বলেন, এলাকার সড়কের পাশের নালাগুলো খোলা পড়ে আছে। মাসে একবারও পরিষ্কার করা হয় না। সেখানে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার লারভা জন্ম নিচ্ছে। তাতে এলাকার নারী-শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছেন। ঘরে মশারি টাঙিয়েও মশার কামড় থেকে পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করা যাচ্ছে না।
শহরে ডেঙ্গু রোগী আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে জানিয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. আশিকুর রহমান বলেন, বর্ষণ ও শহরের জলাবদ্ধতার কারণে মশার বংশবিস্তার ঘটছে। এ কারণে আগের তুলনায় ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে কয়েক গুণ।
পৌরসভার বড়বাজার, বাজারঘাটা, বৈদ্যঘোনা, ঘোনাপাড়া, টেকপাড়া, তারাবনিয়াছড়া, আলীরজাহাল, ঝাউতলা, লালদিঘির পাড়, এন্ডারসন সড়কসহ বিভিন্ন এলাকার অর্ধশতাধিক বেশি সড়কের পাশে নালা-নর্দমা আবর্জনায় ভরে আছে। কিছু এলাকায় সড়কের পাশেও আবর্জনার স্তূপ।
শুধু শহরে নয়, গ্রামেও ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হচ্ছে। উপজেলা শহর ও মফস্বলেও ডেঙ্গু আক্রান্ত সববয়সী নারী-পুরুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন। আক্রান্তদের অধিকাংশেরই রক্তে প্লাটিলেট কম আসছে। সচেতন ভাবে কয়েকদিন জ্বরের চিকিৎসা নেয়ার পর চরম দুর্বলতায় ভোগছেন ডেঙ্গু আক্রান্তরা।
স্থানীয় ও ব্যবসায়ীদের মতে, সকাল-সন্ধ্যা মশার উৎপাত বেড়ে যায়। তখন ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়ে। ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে সড়কের পাশ দিয়ে আসা-যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
কক্সবাজার সেন্ট্রাল হাসপাতালের পরিচালক মো. খোরশেদ আলম বলেন, সরকারি হাসপাতালের মতো বেসরকারি হাসপাতালেও ডেঙ্গু আক্রান্তরা সমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত পক্ষকালে এমন অবস্থা বিরাজমান ছিল, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ঠাঁই না হয়ে চট্টগ্রাম অন্যস্থানে পাঠাতে হয়েছে। এখন একটু কমে এসেছে ভয়াবহতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজার পৌরসভার এক দায়িত্বশীল বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ওইদিন থেকে পৌরসভার মেয়র ও অধিকাংশ কাউন্সিল আত্মগোপনে রয়েছেন। এরপর থেকে শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো তদারকি হচ্ছে না। যে কারণে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহি মশার উৎপাত ও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, পর্যটন শহর হিসেবে কক্সবাজারকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব সবার। শুধু ডেঙ্গু নয়, সবধরণের রোগের জীবাণু প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সববিভাগ মিলে একসাথে কাজ করার উদ্যোগ চলছে। আশা করি অতিদ্রুত সফলকাম হবো আমরা।