সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় শিবিরগুলো থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। গত পক্ষকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে যাওয়া ৭৮৭ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। এদের মাঝে ৪৮ জন নারীও রয়েছে। সর্বশেষ বুধবার (৬ এপ্রিল) পালানোর সময় ১২৮ জনকে আটক করা হয়েছে। রাতে টেকনাফের সাত ক্যাম্পে ১৬ এপিবিএন তল্লাশি চালিয়ে ১৫২ জনকে আটক করে। এর আগে দু’দিন ৪ ও ৫ এপ্রিল আরো ১৮৪ জনকে আটক করা হয়। দেড় সপ্তাহ আগে মালয়েশিয়া যাবার প্রাক্কালে সোনাদিয়া, বাহারছড়া এলাকা হতে আটক হন ১৯৯ জন।
প্রশাসনকে ম্যানেজ করে প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বের হলেও সন্ধ্যায় অনেকে আবার ফিরে আসছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এদের কেউ কেউ মালয়েশিয়া যেতে দালালের আস্তানায় যাচ্ছে আর বিশাল একটি অংশ জেলাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে বলে অভিমত ওয়াকিবহাল মহলের। এভাবে খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে অনেক রোহিঙ্গা। আবার রোহিঙ্গাদের আগ্রহে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মানবপাচারকারী চক্র। ৫ এপ্রিল মানব পাচার চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাই রোহিঙ্গাদের অবাধে ক্যাম্প থেকে বের হওয়াকে ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
উখিয়া থানার ওসি আহমেদ সনজুর মোরশেদ বলেন, বুধবার সকালে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কাজের সন্ধানে যাবার প্রাক্কালে ১২৮ জনকে আটক করা হয়। এর আগে মঙ্গলবার উখিয়া স্টেশনের আশপাশ থেকে আটক করা হয় ৮০ জনকে। আর সোমবার আটক হয় ১৮৪ জন। এদের মাঝে ৬ জন পাচারকারীও ছিলেন। একইদিন টেকনাফ থানা পুলিশের অভিযানে আটক হন আরো ৫০ জন। আটকদের কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়।
ওসি আরও জানান, মানবপাচারে জড়িত থাকার অপরাধে আটক ৬ জনের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা হয়েছে (নম্বর-১৯/২২)। মামলায় আরো ৭/৮ জনকে পলাতক আসামি করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্র মতে, গত ২১ মার্চ মহেশখালীর সোনাদিয়া হতে উদ্ধার হন ১৪৫ রোহিঙ্গা। পাচার চক্র মালয়েশিয়া বলে তাদের সোনাদিয়ার চরে নামিয়ে দিয়ে লাপাত্তা হয় বলে খবর প্রচার হয়। এছাড়াও ২৫ মার্চ টেকনাফের বাহারছরা উপকূল হতে ট্রলারের কুটরি থেকে নারী-শিশুসহ ৫৪ জনকে উদ্ধার করে শৃঙ্খলা বাহিনী।
টেকনাফ ক্যাম্পে দায়িত্বরত ১৬ এপিবিএন সূত্র জানায়, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা হতে রাত ১০টা পর্যন্ত ১৬ এপিবিএনের দায়িত্বাধীন ৭টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রবেশ-বাহির নিয়মিত তল্লাশী চালানো হয়। এসময় ক্যাম্পে প্রবেশকালীন ক্যাম্প-২১ (চাকমারকুল)১৮ জন, ক্যাম্প-২২ (উনচিপ্রাং) ১৯ জন, ক্যাম্প-২৪ (লেদা)১৪ জন, ক্যাম্প-২৫ (আলীখালী) ০৯ জন, ক্যাম্প-২৬ (শালবাগান) ২২ জন, ক্যাম্প-২৭ (জাদিমুড়া) ৩১ জন এবং নয়াপাড়া রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে ৩৯ জনসহ মোট ১৫২ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। এসব রোহিঙ্গারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে অবৈধভাবে ক্যাম্পের তারকাটার বেষ্টনীর কাটা অংশ দিয়ে বাইরে গিয়েছিল বলে স্বীকার করেছেন। আটক রোহিঙ্গাদের পুনরায় অবৈধভাবে ক্যাম্পের বাইরে না যাওয়ার শর্তে সংশ্লিষ্ট মাঝির জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এখন বেকায়দায় স্থানীয়রা। ক্যাম্প কেন্দ্রিক সেনা কার্যক্রম ও তল্লাশি চৌকি ছিলো, তা তুলে নেয়া উচিত হয়নি। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কমিটিতে রাখা হয় না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকালদের স্বার্থ রক্ষায় কথা বলার মানুষ নেই। রহস্যময় কারণে, ক্যাম্প প্রশাসন ও তদারককারি এনজিওগুলোর সাথে বুঝাপড়ায় রোহিঙ্গারা অবাধ বিচরণের সুযোগ পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এটা ক্ষতির কারণ হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর পর এসব রোহিঙ্গারা টেকনাফ-উখিয়াসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় অল্পমূল্যে শ্রমকাণ্ডে জড়ি পড়েছে। এতে করে স্থানীয়রা কর্ম হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছে। ক্যাম্প ছেড়ে রোহিঙ্গাদের পালানোর কথা স্বীকার করেছে সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, তথ্য এসেছে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পের বাইরে আসা রোহিঙ্গারা সস্তায় শ্রম বিক্রি করে। তারা বিভিন্ন পরিবহনের চালক ও চালকের সহকারী বা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। কেউ কেউ বাসা-বাড়িতে গিয়েও কাজ করার তথ্য আছে। এতে স্থানীয় শ্রমজীবীরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি এসব রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় অপরাধী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠায় জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে আসার প্রবণতা রোধে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। আটকের পর তাদের ফের নিজ নিজ শিবিরে পাঠানোর হচ্ছে।
ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের পালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ৮ এপিবিএনের অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) শিহাব কায়সার খান বলেন, আশ্রয় শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের বসবাস। সে হিসেবে আমাদের সদস্য সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। এপিবিএন ১৪, ১৬ এবং ৮ তিনটি ব্যাটেলিয়ন মিলে নিরাপত্তা কর্মীর সংখ্যা মাত্র ২০০০ হাজার মত। ক্যাম্পের বিশাল এরিয়া কাঁটাতারের ঘেরা দেয়া হয়েছে। কাঁটাতারের সব জায়গায় গাড়ি বা পায়ে যোগাযোগও দুরূহ। কিন্তু সেসব এলাকায় রোহিঙ্গা সহজে চলে গিয়ে কাঁটাতারের নিচে চলাচল পথ করে বাইরে চলে যায়। খবর পেলে আমরা ক্যাম্প ইনচার্জকে (সিআইসি) জানিয়ে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করি।
তিনি আরও বলেন, আবার বেশ কিছু এলাকায় রোহিঙ্গাদের খাবার সরবরাহ করা হয় ক্যাম্পের বাইরে। তখন তাদের সেখানে যেতে দেয়া লাগে। এখান থেকেও অনেকে কাজের সন্ধানে চলে যায় বলে খবর পাই। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি, রোহিঙ্গারা যেন ক্যাম্পের বাইরে যেতে না পারে।
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে ইচ্ছে মতো বের হয় আবার ঢুকে। তারা ইতোমধ্যে উখিয়ার প্রায় শ্রম বাজার দখল করে নিয়েছে। কিন্তু সব কিছু দেখার পরও প্রশাসন নীরব। এতে করে স্থানীয়রা অসহায় হয়ে পড়ে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসন স্থানীয়দের চলাচলে বাঁধা দিলেও রোহিঙ্গাদের চলাফেরায় তেমন একটা বাঁধা দিতে দেখা যায় না। এ কারণে রোহিঙ্গারা দেশের আনাছে কানাছে ছড়িয়ে পড়ছে বলে দাবি করেন এ জনপ্রতিনিধি।
এবিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার মো. সামছুদ দৌজা নয়ন বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। তারপরও কোন কোন রোহিঙ্গা আরো সচ্ছল জীবনের আশায় বা অপরাধে জড়াতে শৃঙ্খলে বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছে। তবে, বিশেষ অনুমতি ছাড়া রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচল বন্ধে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।