সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
পাচারকারিদের প্রলোভনে সাগর পথে মালয়েশিয়া যেতে মরিয়া হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা। তাই নিরাপদ আশ্রয়ের পাশাপাশি জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় রসদ পেয়েও উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্প ছাড়ছেন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ।
নৌ-পথে মালয়েশিয়া যাবার প্রচেষ্টার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মক্ষেত্র খুঁজে বাংলাদেশে স্থায়ী বসতি গড়ার পরিকল্পনায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছাড়ছে বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।
গত কয়েকদিনে উখিয়া-টেকনাফ, মহেশখালী ও কক্সবাজার সদরের সাগরতীরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে কয়েকশত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে অভিযানকারিরা। এদের মাঝে অধিকাংশই নারী। যারা বিবাহ যোগ্য বা বিধবা।
এসব ঘটনায় পাচারকারিদের ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃংখলা বাহিনী। ফলে রোধ হচ্ছে না রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প পালানোর অপচেষ্টা।
প্রশাসনের তথ্যমতে, আশ্রিত রোহিঙ্গার তুলনায় ক্যম্প ভিত্তিক নিরাপত্তাকর্মীর উপস্থিতি অপতুল হওয়ায় রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ত্যাগ রদ হচ্ছে না। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের ভাষা, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ স্থানীয়দের সঙ্গে অনেকাংশে মিল থাকায় শৃংখলা বাহিনীর ভিন্ন জেলার সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে কৌশলে ক্যাম্পের চেকপোস্ট অতিক্রম করছে রোহিঙ্গারা।
আইন শৃংখলা বাহিনীর সূত্র মতে, বুধবার ভোররাতে কক্সবাজারের টেকনাফের নোয়াখালী পাড়া থেকে নারীসহ ৩১ মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাকে আটকে দিয়েছে পুলিশ। তারা সবাই সাগরপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছিল বলে দাবি করেছে পুলিশ। এদের ২০ জন নারী, ৪ জন শিশু ও ৭ জন পুরুষ রয়েছে।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি (তদন্ত) এবিএমএস দোহা জানান, টেকনাফের নোয়াখালী পাড়া এলাকায় দিয়ে সমুদ্র্রপথে একদল রোহিঙ্গা মালয়েশিয়ায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন খবরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৩১ রোহিঙ্গাকে আটক করে। তারা সবাই বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবির থেকে এসেছে।
সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশে কক্সবাজারের কলাতলীর শুকনাছড়ি ও দরিয়ানগর সমুদ্র ঘাটে জড়ো করা ২৮ নারী-পুরুষ ও শিশুকে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় জনতার সহায়তায় আটক করেছে কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ। এদের মাঝে ১৩ জন নারী, ৯ জন পুরুষ ও ৬ শিশু রয়েছে। এসময় পাচারকাজে জড়িত একটি নৌকাও জব্দ করা হয়।
একইদিন রাত ১১টায় জালিয়াপালং ইউনিয়নের লম্বরী পাড়া এলাকায় একটি বাড়িতে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশে রাখা ২৪ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে উখিয়া থানা পুলিশ। পাঁচদিন আগে টেকনাফের হ্নীলা জাদিমোরা ঘাট দিয়ে তাদের বাংলাদেশে এনে তাবাইয়া নামের এক ব্যক্তি মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে লম্বরীপাড়াস্থ তার বাড়িতে পাঁচদিন জমা রাখে।
আবার, মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কক্সবাজারগামী যাত্রীবাহী গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নারী, পুরুষ, শিশুসহ ২৭ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে উখিয়া থানা পুলিশ।
তারা জানায়, কক্সবাজার লিংক রোড পর্যন্ত পৌঁছে দিতে জনপ্রতি ৫০০ টাকা দালালদের দেয়া হয়। প্রচন্ড গরমে বালুখালী ক্যাম্পে ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে পলিথিনের ছাওনিতে বাস করতে নাভিশ্বাস উঠছিল। তাই কোথাও ভাড়া বাসা নিয়ে আপতত থাকতে কক্সবাজারে আসছিল তারা। আর সুযোগ পেয়ে সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়াই তাদের মূল লক্ষ্য বলে জানান তারা।
অন্যদিকে, কক্সবাজারের টেকনাফ ও মহেশখালী থেকে নৌপথে মালয়েশিয়া যাবার জন্য জড়ো হওয়া ২০ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে রোববার রাতে পৃথক সময়ে আটক করেছে পুলিশ। তাদের মাঝে ১১ নারী, ৭ পুরুষ ও ২ শিশু রয়েছে।
আবার, বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়ার চেষ্টাকালে আটক শুক্রবার ভোরে রাজধানীর খিলক্ষেতের মধ্যপাড়া এলাকার কহিনুর ভিলা থেকে ২৫ রোহিঙ্গা নাগরিকসহ ২৭ জনকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এদের অধিকাংশই কিশোরী। এ ঘটনায় খিলক্ষেত থানায় একটি মামলা করেছে পুলিশ। ২৩ রোহিঙ্গাকে আদালতের নির্দেশে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রোববার বিকেলে ঢাকা থেকে উখিয়া থানায় পাঠানো হয়। উখিয়া থানার পুলিশ রোববার সন্ধ্যা নাগাদ উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের ৭ জন, বালুখালীর ২ জন, থাইংখালী ক্যাম্পের ৪ জন, হাকিমপাড়া ক্যাম্পের ২ জন, ক্যাম্প ১৬’র একজন ও টেকনাফের নয়াপাড়া মোচনী ক্যাম্পের ৭ জনসহ ২৩ জনকে সংশ্লিষ্ট ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছে।
ক্যাম্পে ফেরা কয়েকজন রোহিঙ্গা কিশোরী বলেন, তাদের ভালো চাকরি দেয়ার কথা বলে রোহিঙ্গা স্বামী-স্ত্রী আইয়ুব ও আসমা আক্তার ঢাকায় নিয়ে যান। ঢাকায় একটি বাড়িতে অবস্থানকালে পুলিশ তাদের আটক করে।
এরা ছাড়াও, উখিয়া-টেকনাফের প্রায় ৩১টি ক্যাম্পের কোন না কোন ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক শতাধিক মানবপাচারকারী সক্রিয় রয়েছে। তাদের নিয়োজিত দালালরা ক্যাম্প অভ্যন্তরে ঘুরে ঘুরে নানান প্রলোভন দিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশু-কিশোরদের মালয়েশিয়া যেতে উদ্বুদ্ধ করছে। তাদের কথায় রাজি হওয়া রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় জড়ো করে সুযোগ বুঝে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করছে। গত চারমাসে প্রায় পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা মানবপাচারের শিকার হয় বলে দাবি করেছে একটি অসমর্থিত সূত্র। গোপন পথে অনেকে মালয়েশিয়া পৌছে গেছে এমন খবর পাবার পর থেকে ক্যাম্প ছাড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
রোহিঙ্গা সূত্র জানায়, প্রায় বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে অনেকে রয়েছেন- যাদের মিয়ানমারের আরাকানে বিত্তশালী ছিলেন। তাদের আলিশান বাসাবাড়ি ছিল। তারা এখানে ঝুপড়ি ঘরে নিজেদের কোনভাবেই মানিয়ে নিতে পারছেন না। তার উপর প্রচন্ড দাবদাহে উত্তপ্ত পরিবেশে ছোট বাচ্চা কিংবা বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে বাস করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ফলে তারা প্রশান্তির আশায় ক্যাম্প ছাড়ছে। আর মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করা স্বজনদের কাছে ফিরে যেতে বৈধ অবৈধ সব পথেই চেষ্টা চালাচ্ছেন। বৈধ পথে যেতে অবৈধ ভাবে বাংলাদেশী পাসপোর্ট সংগ্রহ করে আকাশ পথে পাড়ি দেয়ার চেষ্টাও করতে তারা। যারা এখানে পাসপোর্ট পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন তাদের অনেকে বর্ডার ক্রস করে পার্শবর্তী দেশ ভারতে গিয়ে সেখান থেকে পাসপোর্ট করে স্বজনদের কাছে যাচ্ছেন। কেউ কেউ দেশ ত্যাগে সফল হলেও অধিকাংশই আবার শৃংখলাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়া সহজ প্রচারে কক্সবাজারের মানব পাচারকারী চক্রটি আবারও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। এজন্য তারা রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে ফাঁদে ফেলছে। আর উন্নত জীবনের স্বপ্নে রোহিঙ্গারাও ক্যাম্প ত্যাগ করে বিভিন্নস্থানে জড়ো হচ্ছে। পাচারকারী চক্রটি প্রচার করে, রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য বড় জাহাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাহাজটি গভীর সাগরে অপেক্ষমাণ রয়েছে। এজন্য রোহিঙ্গারা ঝুঁকি নিয়ে ওই জাহাজের উদ্দেশ্যে রওনা হতে মরিয়া হয়।
উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের বলেন, প্রতিদিন রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছেন। পথে অনেকেই ধরা পড়ছেন। আবার সাগরপাড়ে রাতের আঁধারে ধরা পড়ছেন কেউ কেউ। সড়কের বিভিন্ন স্থানে যাত্রীবাহি গাড়ী ও পথচারীর বেশ ধরে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্য ক্যাম্প পালানো রোহিঙ্গাকে আটক করা হচ্ছে। আটকদের থানা হেফাজতে রাখলে তাদের খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে। প্রতিদিন অগনিত রোহিঙ্গা পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে। এসব রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ত্যাগ করে মালয়েশিয়া অথবা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লে একদিন ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তাই রোহিঙ্গাদের অবৈধ পথে দেশ ত্যাগের অপচেষ্টা রোধে আইনশৃংখলা বাহিনীর চেষ্টার কমতি নেই।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, মানব পাচারকারীদের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। তাদের প্রতিহত করতে কাজ করছে সব থানার পুলিশ। স্থানীয় জনগণকেও এতে সামিল হতে অনুরোধ জানান তিনি।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো.আবুল কালাম বলেন, তালিকাভূক্ত প্রতিটা রোহিঙ্গা পরিবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে জীবনধারণ পণ্য রবরাহ করা হচ্ছে। সবাই দেখে থাকবেন, রোহিঙ্গাদের দেয়া অনেক পণ্য তারা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে তাদের প্রয়োজন অনুপাতে ভোগ্যপণ্য না পাওয়ার অভিযোগটি মিথ্যা হিসেবে প্রমাণ হচ্ছে। পূর্বে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশী সেজে প্রবাসে গেছেন তাদের মতো সুযোগ পাওয়া যায় কিনা বা দালালদের আশ্বস্ত করা বাণী শুণে হয়তো তারা ক্যাম্প ছাড়ছে। মানবিক আশ্রয় দেয়ার কারণে সরকার তাদের সাথে নম্র আচরণ করছে। এটার সুযোগ নিলে প্রশাসনকে আরো কঠোরতা দেখাতে হবে। এরপরও তাদের সারাদেশে ছড়াতে বা বিদেশ গমণের সুযোগ দেয়া হবে না। তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে বিশ্বসম্প্রদায়ের সহযোগিতায় কাজ করছে সরকার।
বাংলাধারা/এফএস/এমআর