এবারের কোরবানির ঈদে সাড়ে তিন লাখ চামড়া কেনার আশা করছেন চট্টগ্রামের আড়তদাররা; গতবারের তুলনায় লবণের দাম কম থাকায় স্বস্তির কথাও তারা বলছেন।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়ৎদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সহ সভাপতি আব্দুল কাদের জানান, গতবছর কোরবানির ঈদে প্রায় তিন লাখ ৪২ হাজার কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল। এর মধ্যে আড়াই লাখের বেশি ছিল গরুর চামড়া। এবারের ঈদেও আমরা সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের টার্গেট করেছি।
কাদের বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে টাকা পাওনাসহ নানা কারণে চট্টগ্রামে আড়তদারের সংখ্যা কমে গেছে। আগে প্রায় ২৫০ জন আড়তদার চামড়া সংগ্রহ করতেন। গত কয়েক বছরে তা কমতে কমতে ২০/৩০ জনে দাঁড়িয়েছে। এত অল্প আড়তদারের পক্ষে বেশি চামড়া সংগ্রহ করা সম্ভব না।
তবে গতবছরের তুলনায় এবছর লবণের দাম কম থাকায় এবং বাজার পরিস্থিতি ‘ভালো থাকায়’ অনেকটা স্বস্তিতে থাকার কথা বললেন আড়াতদার সমিতির এ নেতা।
বাংলাদেশে পশুর চামড়ার যে চাহিদা, তার ৮০-৯০ শতাংশই পূরণ হয় কোরবানির ঈদে। ফলে এটাই চামড়া সংগ্রহের মৌসুম।
আগামী ১৭ জুন বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ হবে। রেওয়াজ অনুযায়ী পরের দুই দিনও কিছু পশু কোরবানি চলবে। ওই সময় পাড়া-মহল্লা থেকে কাঁচা চামড়া কিনে বা সংগ্রহ করে মৌসুমি ক্রেতারা তা বিক্রি করবেন আড়তে। আড়ত সেই চামড়া কিছুটা প্রক্রিয়াজাত করে ট্যানারিগুলোর কাছে বিক্রি করবে।
ঈদ সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার; ঢাকায় গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে ৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩ টাকা বেড়েছে।
ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়; গত বছর এই দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।
ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, গতবছর যা ৪৭ থেকে ৫২ টাকা ছিল।
এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হবে ট্যানারিতে, যা গত বছর ছিল ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা, যা আগের বছর ছিল ১২ থেকে ১৪ টাকা।
আড়ৎদার সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘সরকারের বেঁধে দেওয়া দামটি সংরক্ষণের পরের দাম, যা অনেক কোরবানিদাতা কিংবা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বোঝেন না। তারা মনে করেন সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে আড়তদাররা চামড়া কিনবেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।’
ট্যানারি মালিকরা চামড়া কেনার সময় ২০ শতাংশ কর্তন করে চামড়া কিনে থাকেন। আবার সব চামড়া চট্টগ্রামে বিক্রি হয় না। সে কারণে চামড়া ঢাকায় পাঠানোর প্রয়োজন হয়, তাতে গাড়ি ভাড়া এবং অতিরিক্ত আড়ত খরচ বৃদ্ধি পায়।
মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘এবছর গরমের তীব্রতা আগের বছরগুলোর চেয়ে বেশি, যেটা চামড়া সংগ্রহের জন্য অনূকূলে নয়। চামড়া রেখে দিলে খুব তাড়াতাড়ি সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে অনুরোধ থাকবে চামড়া সংগ্রহ করার পর যাতে লবণ দিয়ে রাখা হয় এবং নিজেদের কাছে রেখে না দিয়ে যাতে আড়তে নিয়ে আসা হয়।’
লবণের দাম
চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া আড়তদারদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১০০টি চামড়া সংরক্ষণের জন্য এক বস্তা (৭৪ কেজি) লবণের প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রতিবছর কোরবানির ঈদের মাস খানেক আগে থেকে বাজারে লবণের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এবছর কিছুটা বাড়ানো হলেও গত বছরগুলোর তুলনায় তা কম বলে জানালেন আড়তদার সমিতির সহ-সভাপতি কাদের। তিনি বলেন, গত বছর প্রতি বস্তা লবণের দাম ছিল এক হাজার ৫০ থেকে ১১ শ টাকা। এবছর তা ৯৩০ টাকার মধ্যে আছে।
মুসলিমও জানালেন, এ বছর লবণের দাম আগেরবারের তুলনায় কম। কোরবানির মৌসুমের আগে প্রতি বস্তা লবণের দাম ৮৫০ টাকা ছিল। চামড়ার মৌসুমে কিছুটা বাড়লেও তা ‘সহনীয়’ পর্যায়ে আছে।
মাঠে থাকবে গাউসিয়া কমিটি
‘ন্যায্য দাম’ না পাওয়ার অজুহাতে ২০১৯ সালে মৌসুমি ক্রেতারা সড়কে ফেলে রাখে কোরবানির পশুর চামড়া। ফলে বিপুল পরিমাণ চামড়া নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরের বছর মহামারী ও লোকসানের শঙ্কায় কোরবানিকেন্দ্রিক মৌসুমি ব্যবসায়ীর সংখ্যা একেবারেই কমে গিয়েছিল। ২০২১ সালে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীর দেখা মিললেও তারা আড়তদারদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমেই চামড়া কিনেছিলেন।
তবে গত দুই বছর গাউসিয়া কমিটি চামড়া সংগ্রহ করায় ফড়িয়া ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দাপট আর ছিল না।
আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহম্মদিয়া সুন্নীয়া ট্রাস্টের অধীনে দেশে পরিচালিত হয় দুই শতাধিক সুন্নীয়া মাদ্রাসা। এ ট্রাস্টের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউসিয়া কমিটি। মহামারির মধ্যে কোভিডে মৃতদের সৎকারের মত কাজে সহায়তা দিয়ে এ সংগঠন ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে।
আগের দুই বছরের মত এবছরও চামড়া সংগ্রহে গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা মাঠে থাকবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মোসাহেব উদ্দিন বখতেয়ার।
তিনি বলেন, ‘গত বছর তারা এক লাখের বেশি চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। এ বছর তারা দেড় লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করেছেন। মহানগরীর পাশাপাশি উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে আমাদের সদস্যরা কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করবে। সেগুলো আমদের কাছ থেকে কিনে নেবেন এক আড়তদার।’
বখতেয়ার জানান, যে আড়তদার তাদের কাছ থেকে চামড়া কিনে নেবেন, তিনি নিজস্ব লোকবল দিয়ে সেগুলোতে লবণদেয়াসহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন।
আগের দুই বছর মুরাদপুর সুন্নীয়া মাদ্রাসা মাঠে চামড়া সংগ্রহের পর প্রাথমিকভাবে সংরক্ষণ করা হলেও এবছর সেখানে রাখা হবে না বলে জানান তিনি।
বখতেয়ার বলেন, কোরবানির ঈদের পর আমাদের ওরশ আছে। যার কারণে এবার মাঠে রাখা হবে না। আড়তদার চামড়া রাখার স্থান নির্ধারণ করে দেবে। সেখানেই রাখা হবে সংগ্রহ করা চামড়া।
তিনি জানান, চট্টগ্রাম নগরীতে চামড়া সংগ্রহের জন্য তাদের সংগঠনের অন্তত ৭ হাজার কর্মী কাজ করবেন। যার মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীতে থাকবে চার থেকে পাঁচ হাজার। আর উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে আরও দুই হাজার কর্মী থাকবেন চামড়া সংগ্রহ করার জন্য।
চামড়া সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রাম নগরীতে ১০০টি ও বিভিন্ন উপজেলায় আরও ১০০টিসহ মোট ২০০ গাড়ি থাকবে। সূত্র : বিডিনিউজ