ksrm-ads

২৬ এপ্রিল ২০২৫

ksrm-ads

চট্টলবীর; জনমানুষের নন্দিত নেতা

সম্পাদকীয় »

এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী কারও কাছে ছিলেন রাজনৈতিক গুরু, কারওবা সহযোদ্ধা, কেউ আবার তাকে মানতেন অভিভাবক হিসেবে। এখনো তিনি কারও কারও কাছে ‘মেয়র সাব’। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সাবেক নগর পিতা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এ প্রবীণ রাজনৈতিক নেতার জীবন ছিল নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতায় ভরপুর। সব বাধাকে জয় করে যিনি হয়েছিলেন জনমানুষের নন্দিত নেতা। পেয়েছেন চট্টল বীরের খেতাব।

১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে তার জন্ম। বাবা হোসেন আহমদ চৌধুরী আর মা বেদুরা বেগম। আট ভাইবোনের মাঝে মহিউদ্দিন ছিলেন মেজ। তার বাবা চাকরি করতেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে। বাবার চাকরির সুবাদে মহিউদ্দিন পড়াশুনা করেছেন মাইজদি জেলা স্কুল, নগরীর কাজেম আলি ইংলিশ হাই, আর প্রবর্তক সংঘে। স্কুল জীবনেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে।

মাধ্যমিকের শেষে বাবার আদেশে ভর্তি হন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে। পরে সেখান থেকে ভর্তি হন চট্টগ্রামের অন্যতম বিদ্যাপিঠ চট্টগ্রাম কলেজে। সেখানে বেশিদিন ছিলেন না। এরপর ভর্তি হন কমার্স কলেজ। সেখানেও শেষ করতে পারেননি। শেষে ভর্তি হন সিটি কলেজ। সিটি কলেজেই তার বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে।

রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই মহিউদ্দিন চৌধুরী জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসেন। পাকিস্তান আমলে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাকায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশ শত্রু মুক্ত করার আন্দোলন করায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দলের অস্তিত্ব ধরে রাখায় বারবার শাসক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তারপরও রাজনীতি ছাড়েননি। আঘাত পেয়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এভাবেই দলমতের ঊর্ধ্বে গিয়ে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন। পেয়েছিলেন ‘চট্টলবীর’ উপাধি। তাইতো দল, মত নির্বিশেষে সবাই প্রয়াত এই নেতার প্রশংসাই করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে পাকবাহিনির কাছে গ্রেফতার হন অসংখ্যবার। ১৯৬৮ ও ‘৬৯ সালে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মহিউদ্দিন একাত্তরে গঠন করেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে আইএসআই (পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা) চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমি সদর দফতরের কাছ থেকে আটক হন। এরপর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় চার মাস। পরে পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন সম্মুখ সমরে। যুদ্ধ করেন ভারত-বাংলা যৌথবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে।

পঁচাত্তরে জাতির জনক সপরিবারে নিহত হওয়ার পর প্রতিশোধ নিতে মৌলভি সৈয়দের নেতৃত্বে মহিউদ্দিন গঠন করেন ‘মুজিব বাহিনী’। সে সময় ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হলে তিনি পালিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরেন।

দেশে আসলে তার ওপর আরোপিত হয় একের পর এক হুলিয়া। শুরু হয় সামরিক বাহিনীর হাতে নিষ্পেশন, নির্যাতন আর একের পর এক কারাভোগ। জিয়া সরকারের আমলে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন। এসময় তার ভয়ে তটস্থ থাকাতো সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দিতেও তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশে ফিরে আসার পর শেখ হাসিনাকে নগন্য করতে যখন ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর তখন অদম্য সাহসী মহিউদ্দীন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। সব বাধা অতিক্রম করে শেখ হাসিনাকে দলের কাণ্ডারির দায়িত্ব নিতে সহয়তা করলেন।

এরপর এরশাদ সরকারের শাসনামলে স্বয়ং এরশাদকে চট্টগ্রাম অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে সরকারের চক্ষুশূল হন মহিউদ্দিন। এসময় আবারও রাজনৈতিক বন্দি জীবন কাটে তার। ততদিনে চট্টগ্রামের আপামর জনতার নয়নের মণি হয়ে উঠেন মহিউদ্দীন চৌধুরী।

পরবর্তীতে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির অন্যতম সুপুরুষ বলে বিবাচিত হন সর্ব মহলে। ‘৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে দুস্থ জনতার পাশে দাঁড়িয়ে, অসহযোগ আন্দোলনে খালেদার সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে,গরিব-দুঃখী-শ্রমিকের অধিকারের কথা বলে মহিরুহে পরিণত হন আজকের মহিউদ্দিন।তিনি ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনি ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন মন্ত্রীকে পরাজিত করে তৃতীয় বারের মতো চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের তুলনায় ভোটের ব্যবধানও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।
তিনি অবহেলিত চট্টগ্রামের কাণ্ডারি ছিলেন। তার হাত ধরেই চট্টগ্রামের মানুষের প্রত্যাশা অনেকাংশে পূরণ হয়েছে। তিনি জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডর পর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে ইতিহাসে কিংবদন্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন।

সাবেক এ মেয়র স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রাজপথে ছিলেন এবং চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সামনের কাতারে। তিনি প্রজন্ম পরম্পরায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতিবছর বিজয় মেলা আয়োজন করে ইতিহাসে বিরল অবদান রেখে গেছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী কখনও ভোট দখলের রাজনীতি করেননি। তিনি কখনও জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেননি। রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজোশে যে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন চলছে তিনি তার বিরুদ্ধে ছিলেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের গর্ব ছিলেন, অহংকার ছিলেন, তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের নেতা, গণমানুষের নেতা, বিভিন্ন সময়ে অনেক বিভেদের মধ্যেও দলের নেতা কর্মীদের কাছে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। এছাড়াও সব দলের নেতাকর্মীদের কাছে তিনি একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন সকলের নেতা। যেকোন কঠিন সময়ে তিনি চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে দাঁড়াতেন। হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে ৭৩ বছর বয়সে চট্টগ্রামের এই প্রাণপ্রিয় নেতা মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা হয়েছে তা কখনও পূরণ হবার নয়।

বাংলাধারা/এফএস/এআর

আরও পড়ুন