প্রতিবছরই চিকিৎসা সেবা নিতে বাংলাদেশের রোগিরা পাড়ি জমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া এসব রোগীদের পছন্দের তালিকায় বরাবরই থাকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নাম। কম খরচে উন্নত চিকিৎসা, চিকিৎসকদের রোগীবান্ধব আন্তরিক ব্যবহার, পরীক্ষা-নিরিক্ষায় নির্ভুল রোগ নির্ণয়ে আস্থাসহ নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের রোগিরা চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে ভারতমুখী হতে দেখা যায।
দেশে চিকিৎসাসেবার দুর্বলতা, রোগ নির্ণয়ে ভুল রিপোর্ট, অপচিকিৎসাসহ একাধিক কারণে বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা প্রতি মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি হওয়ায় হরহামেশাই মানুষ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ বাংলাদেশী রোগীর পছন্দের তালিয়ায় শীর্ষে ভারত থাকলেও উচ্চবিত্তরা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা নিতে যান। তবে সে হারটা খুবই সামান্য।
ভারতীয় চিকিৎসকদের এক বিবৃতি থেকে জানা যায়, প্রতিবছর বিদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের প্রায় ২২ শতাংশই বাংলাদেশী। তবে সময়ের সাথে সাথে বেড়ে চলেছে এ সংখ্যা।
ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রণালয় জানায়, ২০২০ সালে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে প্রায় ৫৪.৩ শতাংশই বাংলাদেশী। যা অন্যান্য দেশের তুলনায় তুলনামূলক অনেক বেশি।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে আসা কিছু বাংলাদেশী রোগীর সাথে কথা বলে এর কারণ জানতে চাইলে তারা জানান,
ভারতে স্বল্পমূল্যে উন্নতমানের চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যায়। ভারতের চিকিৎসকদের ব্যবহারও অত্যন্ত আন্তরিক। তারা রোগিদের পর্যাপ্ত সময় দেন ও মনোযোগসহকারে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন।
জানতে চাইলে জাহেদুল ইসলাম নামের এক রোগী বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে পেট ব্যাথায় ভুগছিলাম। এ নিয়ে বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফীও করিয়েছিলাম। তবে কোন ফলাফল পাইনি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন সবকিছুই ঠিকঠাক। কিন্তু সময় পেরিয়ে গিয়ে একপর্যায়ে বুঝতে পারি রোগ ঠিকই আছে তবে তা ধরা পড়েনি। তখন আমার শুভাকাঙ্খীরা আমাকে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিচ্ছে।
ভারতীয় চিকিৎসকরা রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সুদক্ষ। ভালো ব্যবহার ভারতীয় চিকিৎসকদের নিছক ভালোমানুষী কিংবা মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি তাদের করপোরেট সংস্কৃতির বাধ্যবাধকতা। যেখানে ভারতীয় চিকিৎসকদের একটা জবাবদিহিতার মধ্যে থাকতে হয়, সেখানে বাংলাদেশী চিকিৎসকরা যেন এর পরোয়া করে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ রোগীর ডাক্তারদের প্রতি একটাই অভিযোগ, ডাক্তাররা রোগীদের পর্যাপ্ত সময় দেন না। এছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডাক্তারদের ব্যবহার রোগীদের সাথে ভালো হয় না।
স্বল্পমূল্যে উন্নত চিকিৎসা সুবিধার পাশাপাশি ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার অন্যতম একটি বড় কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্থলপথে যাতায়াতের সুবিধা। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে যে সময় লাগে তার চাইতে কম সময়ে ভারতে পৌঁছানো যায়। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে ভারতের যাতায়াত খরচও অত্যন্ত সূলভ অর্থাৎ অতি কম খরচে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাতায়াত করা যায়। এছাড়াও বাংলাদেশে ও ভারতের মানুষের খাবার, ভাষা, সংস্কৃতি ও রুচির মিল অনেক বেশি। আর এই মিলগুলোই বাংলাদেশের মানুষকে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার টান অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের রোগীরা ভারতে যান জটিল হার্ট সার্জারি, ক্যানসারের চিকিৎসা, অঙ্গ প্রতিস্থাপন, বন্ধ্যত্ব চিকিৎসা, অস্থি ও অস্থিসন্ধির অপারেশন, স্নায়ুরোগ, কিডনি রোগ, মেডিক্যাল চেকআপ’সহ নানা কারণে। এসব রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশে করা সম্ভব হলেও যার ব্যায় ভারতের তুলনায় অনেক বেশি।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ প্রয়োজনের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আবার অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত অর্থ অদক্ষতার কারণে খরচ করতে পারে না বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।চিকিৎসা নিতে ধনীরা যাচ্ছেন বিদেশে, আর দেশে সেবা নিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে দরিদ্র শ্রেণি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের স্বাস্থ্য খাতে গড় বরাদ্দ ছিল জিডিপির প্রায় ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে বাংলাদেশের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যা গড় ব্যয়ের নিচে এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অবকাঠামোকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও তৃতীয় স্তরে রয়েছে বিশেষায়িত হাসপাতাল। জেলা হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র মাধ্যমিক স্তর হিসেবে বিবেচিত হয়।
কোন এক দেশের মানুষ অন্য কোনো দেশে কম খরচে সু-চিকিৎসার আশায় ভ্রমণ করাকে বলা হয় চিকিৎসা পর্যটন। একটি দেশ নিজেকে চিকিৎসা পর্যটনের গন্তব্যে পরিণত করতে চাইলে তার প্রথম শর্ত হলো দেশে স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা। ভারত সেই কাজটি করতে পেরেছে। শুধু বাংলাদেশি রোগী নয়, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রোগী ভারতে চিকিৎসা নিতে যান।
গত শতাব্দীর শেষ দশকে ভারত সরকার অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করে। এর আওতায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও করপোরেট বিনিয়োগে ভারতে দ্রুত বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠতে শুরু করে। রাষ্ট্রের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে জমি ও কর সুবিধা নিয়ে ভারতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলে লাভজনক ও দৃষ্টিনন্দন অজস্র হাসপাতাল। চিকিৎসা সামগ্রী আমদানিতে ভারতে করের পরিমাণ মাত্র ১২ শতাংশ। ঠিক একই পণ্য বাংলাদেশে আমদানি করতে সরকারকে কর দিতে হয় ৪৫ শতাংশ।
বাংলাদেশে সুসংগঠিত বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত এখনও গড়ে ওঠেনি। তবে ভারতের দেখাদেখি বাংলাদেশেও অনেকেই স্বপ্ন দেখেছেন চাকচিক্যে ভরা করপোরেট হাসপাতাল গড়ে তোলার। কিন্তু বাংলাদেশে করপোরেট হাসপাতাল গড়ে তোলার নেই তেমন সুযোগ-সুবিধা। সেই সাথে ছাড় নেই বিনিয়োগ ও ট্যাক্সেও। সে কারণে বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো যে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন তার মূল্য ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। আর তাই বাংলাদেশের অধিকাংশ রোগী স্বল্পমূল্যে উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান ভারতে।