ঘোষণার ৬ বছর পার হলেও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে কর্ণফুলী উপজেলায় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ। কেননা, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত বাজেটে জমি মিলছে না। ফলে, চিঠি চালাচালিতে বন্দি ফাইল। কোন অগ্রগতি নেই আর। তিন একর ভূমি অধিগ্রহণের মূল্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত বরাদ্দের ৫০ ভাগ বেশি লাগবে এমন দাবি আর ভূমি জটিলতায় আটকে রয়েছে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামের নির্মাণ প্রকল্প।
এতে উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা ও ক্রীড়ামোদী সংগঠকেরা হতাশ রয়েছেন। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে জটিলতা নিরসন করে ধারাবাহিক ভাবে সকল উপজেলায় স্টেডিয়ামের কাজ শুরু হবে বলে আশ্বাস জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক।
উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, এখনও ভূমিই নির্ধারণ করতে পারেনি কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ। তবে প্রাথমিকভাবে উপজেলা কমপ্লেক্স ভবনের পাশেই শিকলবাহা মৌজায় প্রস্তাব করা হয়েছিলো। কিন্তু এখন স্টেডিয়াম তৈরিতে নানা অনিশ্চয়তা ভর করেছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান, কক্সবাজারের চকরিয়া, ঈদগাহ, রাঙ্গামাটির কাপ্তাই, লংগদু ও সদরে ইতিমধ্যে স্টেডিয়াম নির্মাণ হয়ে গেছে। কিন্তু কি কারণে ৬ বছর ধরে কর্ণফুলীতে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণকাজ আটকে রয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিস, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অতিরিক্ত রাজস্ব, অধিগ্রহণ শাখাসহ বিভাগীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তাদের সাথে কথা হলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসে।
এতে তথ্য উঠে আসে, কর্ণফুলী উপজেলায় সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছিলো ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার ভেতরে ৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে তাতে ৩৪০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩০০ ফুট প্রস্থের একটি মিনি স্টেডিয়াম করা। কিন্তু কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ সে সময় সার্বিক বিষয় যাচাই-বাছাই করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন ২২ থেকে ২৩ কোটি লাগবে তিন একর জমি কিনতে।
কিন্তু এ প্রস্তাব পেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ পুনরায় চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন জমির দাম বেশি হচ্ছে। কারণ অনেক উপজেলায় খাস জমি বের করেও স্টেডিয়াম নির্মাণ করে ফেলেছে। সুতরাং ব্যয় কমিয়ে প্রস্তাব পাঠানোর নির্দেশনা দেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। পরে কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ সে প্রস্তাবে তেমন আগ্রহ দেখায়নি বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানায়।
তবে কর্ণফুলীর মতো একই পথে হেঁটেছে আনোয়ারা উপজেলাও। তাঁরাও একই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন ৩ একর জমি অধিগ্রহণ করতে ২৪ কোটি লাগবে। সংশ্লিষ্ট উপজেলা এটাই তথ্য দেন ১০-১২ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে তিন একর জমি পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ কর্ণফুলী আনোয়ারায় জমির দাম বেড়েছে অনেক বেশি।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্ণফুলী উপজেলার তৎকালিন দায়িত্বে থাকা এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বর্তমানে এডিসি জানান, ‘যখন কর্ণফুলীতে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের প্রস্তাব আসে তখন কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ জানিয়েছিলেন ২২-২৩ কোটি টাকার মধ্যে সরকার থেকে বরাদ্দ এনে তাঁরা মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে পারবেন। যেহেতু ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। কিন্তু পরে সেটা হয়তো উপজেলা পরিষদ বাস্তবে রুপ দিতে পারেননি ।’
প্রতিবেদকের হাতে আসা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদনেও সে বিষয়টি ফুটে উঠেছে, ৬টি উপজেলায় জমি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। ৮৩টি খাস জায়গার মধ্যে দরপত্র আহবান করা হয়েছে ৭২টি উপজেলা। অধিগ্রহণকৃত জমিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে ৮টি উপজেলায়। তারমধ্যে এনওসি দেওয়া হয়েছে ৮০টি উপজেলার।
৩০টি উপজেলার জমির প্রস্তাব পরিবর্তন হওয়ায় ডিপিপি সংশোধন করতে হবে। ৩য় পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ১৭৩টি উপজেলার মধ্যে ১৭৩টি উপজেলার প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এতে ১৯টি উপজেলা হতে খাস জমির প্রস্তাব পাওয়া গেছে। কিন্তু তাতে কর্ণফুলীর কোন নাম দেখা যায়নি।
কারণ অবশিষ্ট ২৮টি উপজেলার জমির আকার স্টেডিয়াম নির্মাণের উপযোগী নয়/জমির অধিগ্রহণ মূল্য বেশী/প্রস্তাবে জমি অধিগ্রহণ মূল্য নেই সে সকল উপজেলার বিকল্প জমির প্রস্তাব যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় হতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ১২টি উপজেলা হতে সংশোধিত প্রস্তাব ঢাকায় গেছে। সেখানেও নেই কর্ণফুলীর কোন প্রস্তাব। তাহলে কী চিঠি চালাচালিতে আটকে রয়েছে কাঙ্খিত সিদ্ধান্ত।
এদিকে, এই মিনি স্টেডিয়াম তৈরি না হওয়ায় এলাকার ক্রীড়াঙ্গনও মুখ থুবড়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। নতুন খেলোয়াড় যেমন সৃষ্টি হচ্ছে না তেমনি শিক্ষার্থীরা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। মাঠ থাকলে খেলাধুলা করে সময় কাটতো। এজন্য খাস জমি বের করে হলেও স্টেডিয়াম নির্মাণের দাবি তাদের। যেহেতু ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জমি অধিগ্রহণ না করে উপযুক্ত স্থানে খাস জমি খুঁজে স্টেডিয়াম নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই প্রকল্পটি একাধিক ধাপে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ সেলিম হক বলেন, ‘আসলে এটা খুবই দুঃখজনক। এটা নিয়ে কেউ তদবির করে না।আমরা রাস্তাঘাট আর ব্রীজ নিয়ে যতটা ব্যস্ত ততটা খেলার মাঠ নিয়ে উদাস। সামনে আরো ভূমির দাম বাড়বে। তখন আরো হবে না। এ ব্যাপারে ক্রীড়া সংস্থার কোন মতামত পর্যন্ত কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ নেয়নি। আমাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে।’
এ বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরীর কোন মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে ইউএনও মাসুমা জান্নাত বলেন, ‘অফিসে ডিটেইল তথ্য রয়েছে। আপনাকে পরে জানাবো।’
চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের উপ পরিচালক মো. আসলাম হোসেন খাঁন বলেন, ‘ আমি যতটুকু জানি জায়গার সমস্যার কারণে কর্ণফুলীতে স্টেডিয়াম হচ্ছে না। জায়গা মানে টাকা। কর্ণফুলীতে এত জায়গার দাম বেশি কেন জানি না। সরকারের তো একটা বাজেট আছে। ওই বাজেটের ভেতরে করতে হয়। একটা কলমের দাম যদি ১০ টাকা হয়। বাজেট আসে হয়তো ৫ টাকা। তাহলে বাজেট মতো কাজ করতে হবে। আরেকটি সমাধান আছে যদি খাস জমি বের করে দিতে পারে। তাহলেই স্টেডিয়াম করা যাবে।’
তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪ টায় কর্ণফুলীর চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগরের মেরিন ফিশারিজ একাডেমি (বিএফডিসি) মাঠে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট উদ্বোধন করে প্রধান অতিথি তৎসময়ের ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো কর্ণফুলীতে একটি মিনি স্টেডিয়াম তৈরি করতে”।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বিভাগের ১০৪ উপজেলার মধ্যে ১৬টিতে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম ধাপ শেষ হয় বিগত ২০১৯ সালের জুনে। প্রথম ধাপে নির্মিত স্টেডিয়ামগুলোয় নির্মাণ ব্যয় ছিল ৫২ লাখ টাকা। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে তা বেড়ে ১০ কোটি টাকাতে দাঁড়িয়েছে।