চীন থেকে ফায়সাল করিম »
আর মাত্র কয়েক রমজান। তারপরই মুসলিম বিশ্বে বইবে খুশির আমেজ। ঈদের আনন্দে ভাসবে সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ। এই আনন্দ উৎসবের দিনটি কেমন কাটে চীনে বসবাস করা বাংলাদেশীদের, তা নিয়ে কিছুটা বাড়তি আগ্রহ থাকতেই পারে অনেকের। কমিউনিস্ট পার্টি অধ্যুষিত দেশ যার অধিকাংশ নাগরিকই ধর্মীয় আচার-রীতিতে বিশ্বাসী নন, আছে প্রকাশ্য ধর্মীয় চর্চায় কিছু বাধা-নিষেধও। এসবের মাঝে চীনে বাংলাদেশী মুসলমানদের রমজান আর ঈদ পালন আদৌ সম্ভব হয় কি! বিষয়টি ভাবনারই বটে।
এসব নিয়ে অনেক কথা ভাবনায় এলেও বাস্তবে রমজান বা ঈদ পালন এখানকার ভীনদেশী মুসলমানদের জন্য খুব একটা মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। চীন সরকারের ধর্মীয় চর্চার বিধি-নিষেধ মেনেই নিজেদের মত করে এখানে যে কেউই পালন করতে পারেন ধর্মীয় আচার-উৎসব। প্রতিবছরই বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলিম শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা নিতে চীনে আসছেন। তাদের সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। এই প্রবণতাই বলে দেয় চীন ভীনদেশী মুসলমানদের জন্য খুব একটা বৈরী দেশ নয়। ব্যাতিক্রম দেখা যায়নি এবারের রমজানেও।
দেশটির হুবেই প্রদেশের শিক্ষানগরীখ্যাত উহানে এখন বসবাস করছেন কয়েক’শ বাংলাদেশী। এদের মধ্যে মুসলমান শিক্ষার্থীর সংখ্যায় বেশি। এ পুরো রমজানজুড়েই তারা সিয়াম সাধনা করেছেন, নিচ্ছেন ঈদের প্রস্তুতি। চীন দেশের নগরী হওয়ায় প্রকাশ্যে মাহে রমজানের আমেজ না থাকলেও নিজেদের মত করে রোজার আনুষ্ঠানিকতা পালন করছেন অনেকেই।
বাংলাদেশের সময়ের সাথে দুই-ঘন্টার ব্যবধানকে মাথায় রেখে সেহেরি-ইফতারের আয়োজন থাকছে প্রতিদিনই। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক হলগুলোতে নিজ দেশের সহপাঠীদের সাথে কিংবা ভিনদেশের মুসলমান বন্ধুদের নিয়ে ইফতারের আয়োজন বেশ জোরেসোরেই চলে। ছোটখাট মিলনমেলার মত এসব ইফতার বা সেহেরি আয়োজন অনেকটা উৎসবের মতই, জানান বেশ কজন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী।
“দেশ থেকে দূরে ঈদের আমেজ কিছুটা পানসে হলেও ভিন্ন দেশে ভিন্ন অভিজ্ঞতার ঈদ খুব একটা খারাপ নয়”, বলছিলেন উহানের সেন্ট্রাল চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক আবদুল্লাহ আল হাফিজ। তার মতে, দেশের মাটিতে ঈদ করার মত আনন্দদায়ক না হলেও এখানে বিশ্বের নানা দেশের মুসলমানদের সাথে ঈদ উদযাপনের অভিজ্ঞতা সত্যিই অন্যরকম ধর্মীয় অনুভূতি জাগায়। পড়াশোনার সুবাদে প্রায় দুই বছর ধরে চীনে স্ত্রী-সন্তান নিয়েই বসবাস করছেন বলে জানান বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের এ কর্মকর্তা।
ঈদের আগের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে আবদুল্লাহ হাফিজ জানান, “আত্মীয়স্বজনকে উপহার দেয়ার ব্যাপরটি না থাকায় দেশের মত হয়তো খুব বেশি কেনাকাটা করা হয়না তারপরও দুই মেয়ে আর নিজেদের জন্য কিছু কেনাকাটা এরই মধ্যে সেরে নিয়েছি। দু-একদিন পরেই ঈদের দিনের খাওয়া-দাওয়ার জন্য বাজার-সদাইয়ের পরিকল্পনা আছে”।
দ্বিতীয়বারের মত চীনে ঈদ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ঈদ নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি থাকলেও ঈদের দিন নামাজ শেষ করেই হয়তো ল্যাবরেটরিতে ছুটে যেতে হবে”। গবেষণার কাজে প্রচুর চাপ থাকায় এখন প্রতিদিনই তাকে ল্যাবে সময় দিতে হয় বলে, আফসোসে জানালেন। তবে এসবের মাঝেও ঈদের আনন্দ পরিবার ও বাংলাদেশী অন্যান্য ভাইদের সাথে ভাগাভাগি করে নেবেন এমনটাই আশা তার।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হানিফ মিয়া জানান, চীনে তিন বছর ধরে পড়াশুনা করলেও এবারই প্রথম স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে ঈদ করছেন এখানে। পরিবারের অন্যান্য প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব থেকে দূরে এই ঈদ কিছুটা সাদামাটা হলেও, তার মতে এখানকার বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন তার প্রিয়জনের মতই। “এ তিন বছরে নানা সুখ-দু:খ ভাগাভাগি করে নিয়ে তাদের সাথে পরিবারের মতই মিশে গেছি। সে হিসেবে ঈদে বাড়ি না যাওয়ার আফসোস তাদের সাথেই ঈদ-আনন্দে ভাগভাগি করে মিটিয়ে নেব”।
পরিবার নিয়ে ঈদের দিন ঘুরতে যাওয়া ও দেশীয় ভাই-বন্ধুদের সাথে জমপেশ খাওয়া-দাওয়ার মাঝে দূরদেশে ঈদের আনন্দ খুঁজে নিবেন বলে জানান হানিফ মিয়া। এ লালন গবেষক বললেন “ঈদের দিন নামাজ শেষে বিশ্বের নানা দেশের মুসলমানদের সাথে কুশল বিনিময় ও কোলাকুলি নানা বর্ণের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির মেলবন্ধন বাড়িয়ে তোলে, তাই এমন অভিজ্ঞতা মিস করতে চাইনা”।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সহকারী অধ্যাপক শাহীনুর রহমান এখানে পিএইচডি করছেন মনস্তত্ব নিয়ে। ঈদকে সামনে রেখে রোজার এই শেষ কদিন পরিবার নিয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বলে জানান তিনি। “ঈদে বাচ্চার জন্য কেনাকাটা ও অন্যান্য বাজার করতে এরই মধ্যে শহরের বেশ কিছু বিপণীকেন্দ্র আর সুপারশপে ঢুঁ মেরেছি “।
এখানকার মার্কেটগুলোতে পণ্যের দামে ব্যাপক হেরফের আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বেশ কিছু বিপণী বিতান ঘুরে সুলভে ভাল মানের পণ্য খুঁজে নিতে হয় এখানে। যেহেতু ঈদের সাথে চীনাদের কোন সম্পর্ক নেই সেহেতু এখানকার মার্কেটগুলোতে এখন কোন ছাড় বা বাড়তি অফারেরও সুযোগ নেই”। জানালেন “দেশ আর পরিজন থেকে দূরে হলেও ঈদের দিন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে উহানের বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে ঈদের আনন্দ খুঁজে নিব”।
চীনের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় হুয়াজং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী আরাফাত আহমেদ। চীনে বসবাস করছেন প্রায় দুই বছর ধরে। এখানকার সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব আর ডর্মমেটরাই তার কাছে পরিবার। চীনের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে বলেন “ছোটকাল থেকে বাবা-মা আর পরিবারের সাথেই রোজা আর ঈদ করে অভ্যস্ত। তাই এখন সেই রোজা আর ঈদগুলোকে মিস করি খুব। এখানে এসে নানা দেশের নানা বর্ণের শিক্ষার্থীদের সাথে আমার বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে, তাদের অনেকেই আমার পরিবার-প্রিয়জন। উৎসবে, ঈদে দেশে থাকতে না পারার কষ্ট গেল দুই বছর ধরে তাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছি“। ঈদের দিন ভীনদেশের প্রিয় বন্ধুদের সাথে নিয়ে উহান নগরী ঘুরে বেড়াবেন বলে জানালেন এই আইনজীবী ও গবেষক।
চীনের উহানে প্রায় তিন বছর যাবৎ বসবাস করছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আকিব ইরফান। এখানে চীনা ভাষার উপর স্নাতকে পড়াশোনা করছেন তিনি, তাই চীনা কথা বলায় অর্জন করেছেন পারদর্শিতা। এ সুযোগে গড়ে তুলেছেন চীনের নানা সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে সখ্যতা আর বন্ধুত্ব। কথা বলে জানা গেল এ নিয়ে তৃতীয়বারের মত চীনে ঈদ করছেন আকিব।
তিনি জানালেন, “বাংলাদেশের সাথে মিল রেখে আমরা ঈদের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালন করে ফেললেও এখানে ঈদের জামাতের দিনক্ষণের জন্য সাধারণত নির্ভর করতে হয় চীন সরকার সিদ্ধান্তের উপর। তবে গেল তিন বছর ধরে দেখছি রমজান শেষ হওয়ার একদিন পরেই এখানে ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়”। (
প্রতিবছর উহান শহরের মা জিয়া ঝুয়াং, চি ই মেন ও জিয়াং আন এই তিনটি মসজিদে ঈদ জামাতের আয়োজন করা হয় বলে জানালেন তিনি। “এসব মসজিদে বেশ বড়সড়ভাবেই ঈদ জামাতের আয়োজন করা হয়ে থাকে, থাকে সহনীয় পর্যায়ে মাইক ব্যবহারের অনুমতিও”। বাংলাদেশ ছাড়াও মিশর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সুদান, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়া ও আরব দেশগুলোর শত শত বিদেশী শিক্ষার্থী প্রতি বছর ঈদের জামাতে সামিল হয় বলে জানালেন সিসিএনইউর এ শিক্ষার্থী।
বাংলাধারা/এফএস/এমআর