ksrm-ads

১৯ মার্চ ২০২৫

ksrm-ads

চোরদের তীর্থস্থান!

মুজতবা সউদ, ঢাকা »

তারকা খ্যাতি অনেক ভাবেই পেয়ে যেতে পারেন একজন মানুষ। অভিনয় করে, গান গেয়ে, গল্প উপন্যাস কবিতা লিখে, ফুটবল ক্রিকেট বা অন্যকোন খেলায় পারদর্শী হয়ে, রাজনৈতিক নেতা হয়ে এমন কী যুদ্ধ ক্ষেত্রেও পারদর্শীতা দেখিয়ে হয়ে যেতে পারেন তারোকা। কিন্তু চুরি করে কেউ তারকা খ্যাতি পাবেন এমনটা কি ভাবা যায়? অথচ সেটাই হয়েছিলো উনিশ শতকে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব চুরি করে রীতিমতো তারকা খ্যাতি পেয়ে গেছিলেন রাশিয়ার সোফিয়া ব্লায়ুভশটাইন (১৮৪৬-১৯০২)। Sofia Ivanovna Blyuvshtein.

অবশ্য চোরদের তো একটা নাম থাকলে চলে না। চুরির জন্য একেক সময় একেক নাম ব্যাবহার করতে হয়। অন্য কত নাম তিনি কতো স্থানে ব্যাবহার করেছেন তা বলতে পারিনা। তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাকে ‘সোনিয়া দ্য গোল্ডেন হ্যান্ড’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। .Sonia (Son’ka) the Golden Hand; 1846–1902.

সাধারণ কোন জিনিস চুরি করতেন না সোফিয়া। কেবলমাত্র অলংকার। টাকাও নয়। হীরা, মুল্যবান পাথর অর্থাৎ রত্ন এবং সোনার ‘র অলংকার। আর কোন কিছু চুরি করার অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে। এমন সব চুরি করে, তিনি কতো মিলিয়ন ডলার সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। তার হিসেব নেই।

অদ্ভুত সব কায়দায় চুরি করতেন সোফিয়া। তার হাতের আংগুলের নখগুলো ছিলো বড়ো বড়ো এবং ডিজাইন করা। একটি বাঁদর পালতেন তিনি, যাকে চুরির কাজে দিয়েছিলেন বিশেষ প্রশিক্ষণ। কোন জুয়েলারি দোকানে গিয়ে, তিনি নানা রকম গহনা, হীরা, নীলা, চুনি পান্না দেখতেন। দেখতে দেখতে দামী কোন পাথর তিনি লুকিয়ে নিতেন, তার কারুকাজ করা লম্বা নখের ফাঁকে। তারপর পছন্দ হচ্ছে না বা দামে বনছেনা এমন ভান করে বেরিয়ে যেতেন দোকান থেকে। আর তার প্রশিক্ষিত বাঁদরটি দামী কোন স্বর্ণালঙ্কার পুরে নিত মুখের ভেতরে। বড়ো ধরনের চুরির জন্য তিনি পরিকল্পনা করতেন নানান রকম ঘটনার। একটি উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে।

একবার এক স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে গিয়ে, বেশ কিছু দামী গহনা ও রত্ন পছন্দ করলেন সোফিয়া। দোকান মালিককে বললেন পার্সেল করে বাসায় পাঠাতে। সেখানে তার ডাক্তার স্বামী পার্সেল নিয়ে, এগুলোর দাম পরিশোধ করে দেবে। এমন কাস্টমার পেয়ে দকানী নিজেই পার্সেল সহ গেলেন সেফিয়ার দেয়া ঠিকানায়। সোফিয়া সেখানেই ছিলেন।

দোকানিকে বললেন অপেক্ষা করতে। তার স্বামী হাতের কাজ সেরে আসছেন। এটা জানিয়ে পার্সেলটা নিজের কাছে নিলেন। তিনি আগেই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলেন। ডাক্তারকে বলেছিলেন ডায়মন্ড বেচাকেনা করা তার স্বামীর নেশায় পরিনত হয়েছে। নিজের কাছে থাকা রত্নালংকার নিয়েও সে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করতে চলে যায়। এই নেশা থেকে মুক্তির জন্য তিনি তার স্বামীর চিকিৎসা করাতে চান। সেদিন এসেই তিনি ডাক্তারকে জানিয়ে রেখেছিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্বামী এসে যাবে। ডাক্তার এসে দোকানিকে সোফিয়ার স্বামী ভাবলেন। দোকানিও ডাক্তারকে সোফিয়ার স্বামী ভাবলেন। দুজনকে মুখোমুখি নিরিবিলি আলাপ করতে বলে সোফিয়া আস্তে করে সরে পড়লেন। দোকানি তার স্বর্ণালঙ্কার আর রত্ন সমূহের দাম চাইলে ডাক্তার, সোফিয়ার কাছে আগে থেকে শোনা কথা অনুযায়ী দোকানীকে মানসিক রুগী ভাবলেন।

এক পর্যায়ে মানসিক হাসপাতালে খবর দিলেন। প্রায় জোর করেই তাকে মানসিক হাসপাতালে নেয়া হলো। ধোঁয়াশা যখন কাটলো, তখন সোফিয়া পগার পার। বেঈমান সবখানেই থাকে। সোফিয়া ওরফে সোনিয়ার সঙ্গেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তার প্রেমিক ঊল্ফ ব্রমবার্জ করেছিলো বেঈমানী। ধরা পড়ে গেলেন এই খ্যাতিমান চোর। তাকে সাইবেরিয়ার এক জেলখানায় পাঠানো হয়। এক কারারক্ষীকে পটিয়ে তিনি পালিয়েছিলেন জেলখানা থেকে। কিন্তু পুনরায় ধরা পড়েন। এবার তাকে পাঠানো হয়, স্মোলেন্সক জেলখানায়। কিছুদিনের মধ্যেই সেখান থেকেও পালান তিনি।

সবশেষে তিনি যখন ধরা পড়েন তখন দূর্গম সাকালিন দ্বীপের জেলখানায় পাঠানো হয় তাকে। সেখানে তিনবার জেল থেকে বের হতে পারলেও দ্বীপ ছেড়ে ভাগতে পারেন নি। ধরা পড়েন প্রতিবারই। সাকালিন দ্বীপের জেলখানায় সোফিয়া ওরফে সোনিয়ার উপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। হাতে পচন ধরে। কেটে ফেলতে হয় হাত। সাকালিন দ্বীপের জেলখানায় তার সংগে দেখা করেছিলেন প্রখ্যাত রুশ লেখক আন্তন চেখভ। দেখা করেছিলেন আরেক লেখক ভ্লাস দরোশেভিচ। তাদের লেখায় উঠে আসে সোফিয়ার অনেক অজানা কাহিনী।

সাদাকালো নির্বাক ছবির যুগেই তার গল্প নিয়ে ছবি হয়েছে। সাদাকালো সবাক ছবি হয়েছে, রঙিন ছবি হয়েছে, হয়েছে কার্টুন চলচ্চিত্র। এখনো মস্কো সহ রাশিয়ার বিভিন্ন টিভিতে তাকে নিয়ে বিশেষ টক শো হয়ে থাকে। হচ্ছে নাটক এবং ধারাবাহিক। এসব ধারাবাহিকে সোফিয়া ওরফে সোনিয়ার ঘটনাগুলো নানা ভাবে, অনেক নতুন নতুন চরিত্র এবং ঘটনার কাল্পনিক বিস্তার করা হয়ে থাকে। মজার বিষয় হলো অনেক ক্ষেত্রেই তাকে রুশ রবিনহুড হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।

মস্কোতে সোফিয়া ওরফে সোনিয়ার কবর রয়েছে। তবে স্থানটি সনাক্ত করা না থাকলেও, ওই সমাধি ক্ষেত্রটির কোন এক স্থানে তার একটি মুর্তি আছে, যেখানে সোফিয়া ওরফে সোনিয়ার হাত নেই। এখনো সেটা দেখতে আসেন অনেকেই। বলা হয়ে থাকে, রাশিয়ায় চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের তীর্থস্থান এটি। কেউ কেউ সেই হাতকাটা পাথরের মুর্তির নিচে বা আশেপাশে লিখে আসেন, “সোনিয়া, আমাদের ভালো চোর হতে সাহায্য করো”। “Sonya, help us to become good thieves!”

আরও পড়ুন