শ্যামল চৌধুরী: পৃথিবীর একশোটিরও বেশি দেশে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ রয়েছে। মশা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, হলুদ (পীত) জ্বর, ফাইলেরিয়াসিস, জিকা ভাইরাস প্রভৃতি রোগের বাহক। মশাবাহিত এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর প্রাণহানী ঘটে ৭ লাখেরও বেশি মানুষের। গবেষকদের মতে, মশা নিধনে প্রচলিত যেসকল কীটনাশক রয়েছে সেগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে মশার দেহে সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। যেকারণে এসব কীটনাশক বর্তমানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তাই উন্নত দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে প্রধান উপায় লার্ভা ধ্বংসে জৈব পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। কিন্তু গরীব ও উন্নয়নশীল দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে এসব অকার্যকর কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ডেঙ্গুসহ নানা মশাবাহিত রোগ বেড়েই চলেছে।
চট্টগ্রাম নগরবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর নির্দেশে প্রচলিত কীটনাশকসমূহ এবং উদ্ভিদজাত উপাদানে তৈরী এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড মসকুবার (MOSQUBAR) প্রোডাক্টটির স্যাম্পল কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করা হয়। বিশেষজ্ঞ গবেষকদল নগরীর ৯৯টি স্থান পরিদর্শন করে এডিস মশা ও এনোফিলিস মশার লার্ভা সংগ্রহের মাধ্যমে লার্ভাকে বয়ষ্ক মশায় রূপান্তরিত করে গবেষণা করেন। চবির উপাচার্যের নেতৃত্বে গবেষকদল মেয়রের কাছে গবষণার প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।
গবেষণার ফলাফলে জানানো হয় যে, বিষাক্ত কীটনাশকগুলোর স্প্রে ও ফগিং মশা ও লার্ভা নিধনে কার্যকারিতা খুবই নগণ্য। কিন্তু উদ্ভিদজাত মসকুবার এর সাথে ইপিএ অনুমোদিত ৫০ গুণ মিনারেল অয়েল করোসিন স্প্রে করে মশা ও লার্ভা ধ্বংসে শতভাগ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তাই গবেষকবৃন্দ মশা নিয়ন্ত্রণে বিকল্প হিসেবে জৈবপ্রযুক্তি এবং কার্যকর উদ্ভিদজাত পণ্য ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করেন। ঢাকার সায়েন্স ল্যাবে পরীক্ষায়ও মসকুবার শতভাগ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর উদ্যোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই যুগান্তকারী গবেষণার ফলাফলে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণ বা রহস্য উৎঘাটিত হয়। ২০২১ সালে জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই বিষয়ে সংবাদ প্রচারিত হলেও এখনো দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক EPA. CDC এবং EU এর মতো বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
গবেষকবৃন্দের সুপারিশ মোতাবেক ২০২২ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতির মাঝামাঝি সময়ে চসিক এক লিটার “মসকুবার” এর সাথে ৫০ লিটার BPC এর ‘ন্যাফথা’ (কেরোসিনের বিকল্প) মিশিয়ে জলজ প্রজনন ক্ষেত্রে স্প্রে করলে খুবই দ্রুতসময়ে ও ব্যাপকহারে লার্ভা নিধন হয়। সেবছর চট্টগ্রামে সফলভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রিত হয়। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন যাবত BPC ন্যাফথা সরবরাহ বন্ধ রাখে। চলতি বছরে ৬ জুলাই অল্প পরিমাণে সরবরাহ করে বিপিসি। অপরদিকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একমাত্র কার্যকর প্রোডাক্ট ‘মসকুবার’ শুষ্ক মৌসুম থেকে বন্ধ রাখায় এবছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর ব্যাপকতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
মসকুবার ও ন্যাফথার দ্রবণ ঘরের চরপাশে ছোট নালা, পরিত্যক্ত পাত্র ও টায়ার, ফুলের টব, ডাবের খোসা, নির্মাণাধীন ভবনে ও বড় নালার জমানো পানিতে, সেফটি ট্যাংকে, ডাস্টবিন এবং মশার স্থায়ী প্রজননক্ষেত্র বদ্ধ জলাশয় ও ডোবায় স্প্রে করলে তা পাতলা তেলের আবরণ সৃষ্টি করে পানির উপরে ভাসমান অবস্থায় থাকে। পানিতে থাকা মশার লার্ভা ও পিউপা বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণের সময় এই ভাসমান আবরণের উদ্ভিদজাত উপাদানের সংস্পর্শে আসলে তা লার্ভার দেহে জ্বালা সৃষ্টি করে। এতে লার্ভা মারা যায়। তবে এই মৃত্যু কীটনাশকের মতো বিষক্রিয়ায় ঘটেনা।
মশা নিয়ন্ত্রণের বিকল্প পদ্ধতি:
পানি জমার উৎস অপসারণ, ড্রেনগুলির মুখ বন্ধ করে মশার বংশবৃদ্ধি হ্রাস করা, মাছ এবং বিটিআই, বিএস ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে লার্ভা ধ্বংস করা, মশা বিতারক, মশার কয়েল বা পোশাক ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুরক্ষা, জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মশার প্রজনন রোধ করা, আঠালো ফাঁদে স্ত্রী মশাকে আকর্ষণ করা প্রভৃতি।
EPA, CDC, EU Commission ইউরোপ ও আমেরিকায় অকার্যকর কীটনাশক বাতিল করে মশা নিয়ন্ত্রণে প্রধান কৌশল লার্ভা ধ্বংসে মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করে লার্ভানাশক Bti (ব্যাসিলাস খুরিনজিয়েন্সিস ইসরায়েলেন্সিস) ব্যাকটেরিয়া, লার্ভার বুদ্ধি নিয়ন্ত্রক, মিনারেল অয়েল ফ্লিম, উদ্ভিদজাত প্রোডাক্ট প্রভৃতি জৈব প্রযুক্তি চালু হয়েছে। এই জৈব প্রযুক্তি সমূহের একক জৈব বিকল্প উদ্ভিদজাত ‘মসকুবার’ লার্ভা ধ্বংসে দ্রুত কার্যকর। BCSIR এর পরীক্ষা রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে লার্ভা নিধনে EPA নির্ধারিত মিনারেল অয়েল করোসিন (Control) দিয়ে লার্ভার মৃত্যু হার ৫৩.৩৩%, কিন্তু এই কেরোসিনের সাথে ‘মসকুবার মিশিয়ে স্প্রে করলে লার্ভার মৃত্যু হার হবে শতভাগ।
EPA এবং EU Commission বাতিলকৃত এবং CU এর পরীক্ষায় অকার্যকর প্রমাণিত কীটনাশকের ব্যবহার বাংলাদেশে মশা নিয়ন্ত্রণে এখনো অব্যাহত রাখার কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থ হচ্ছে। অনেক আগের অনুমোদিত এসব কীটনাশক বর্তমানে ব্যবহার হলেও বাংলাদেশে উদ্ভিদজাত প্রোডেক্ট পরীক্ষার পদ্ধতি না থাকায় ২০১৯ সালে ভয়াবহ ডেঙ্গু মৌসুমে উদ্ভিদজাত প্রোডাক্টটি পরীক্ষা করে অনুমোদন দিতে মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রীর আদেশও অমান্য করা হয়।
চসিক ব্যবহার শুরু করার পর ‘মসকুবার’ ব্যবহারের জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসমূহে আবেদন ও যোগাযোগ করা হলেও কোন সহযোগীতা পাওয়া যায়নি। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট সংস্থা সমূহের এধরণের অসহযোগিতায় দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী দোর্দণ্ড প্রতাপশালী করোনা মহামারীকে জয় করেছে, ডায়রিয়া রোধ ও টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে মৃত্যুহার কমেছে এবং স্বাস্থ্যকমীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়েছেন। তাই প্রতিবছর ব্যাপকহারে মশার দংশনে এই অকালমৃত্যু বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থায় দক্ষ কর্মীবাহিনীর মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
লেখক : কেমিস্ট ও গবেষক