হাসান সৈকত »
গেল মাসে সিরিয়া সীমান্তের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কে আঘাত হানা ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি। আহত হয়েছে আরও কয়েক লাখ মানুষ। ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্ক যেন এখন এক ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আর এই ভূমিকম্পে টনক নড়ল বাংলাদেশের। বাংলাদেশের মানুষ এখন ভুগছে ভূমিকম্প আতঙ্কে।
ভূতত্ত্ব ও নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানলে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি তুরস্ককেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশে যেকোনো সময়ে আঘাত হানতে পারে ৮.৩ থেকে ৮.৬ মাত্রার ভূমিকম্প। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) আয়োজিত ভূমিকম্প বিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, ঢাকা শহরের মাত্র ২১ শতাংশ ভবন ভূমিকম্প সহনীয়। যথাযথ উদ্যোগ না নিলে শুধু ঢাকা শহরেই প্রাণহানি হতে পারে ৫০ হাজার মানুষের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেছেন, ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ঝুঁকি প্রশমনে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে এছাড়া কোনোভাবেই ভূমিকম্প মোকাবিলা সম্ভব নয়।
ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূ-পৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এই রূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প বলে।
ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে দিনক্ষণ-সময় সুনির্দিষ্ট করে পূর্বাভাস দেয়া আজও সাধ্যের বাইরে। তবে ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগত কিছু আলামত ভূমিকম্পের আলামত বহন করে। তাৎক্ষণিক বা মুহূর্তে ঘটমান এই দুর্যোগ থেকে জীবন রক্ষার জন্য সর্বপর্যায়ে প্রাক-প্রস্তুতি ও গণসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। ত্রুটিপূর্ণ ও অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত বসতঘর ভূমিকম্পের সময় মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে, এ ক্ষেত্রে সারাদেশের মধ্যে সব চাইতে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম।
৮ মাত্রার ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ তার আশেপাশের বেশ কিছু এলাকা। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ ভূ-স্তরে ৪টি বিপজ্জনক ফাটল লাইন রয়েছে, যা প্রবল ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কার দিকনির্দেশ করে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মিনায়নমারে সৃষ্ট ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে কক্সবাজার। চুয়েট ইনস্টিটিউট অব আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চের একটি গবেষণায় বলছে, ৭ থেকে ৮ মাত্রার যেকোনো ভূমিকম্পে ধসে যেতে পারে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের প্রায় দেড় লাখ ভবন। যার মধ্যে রয়েছে সিটি করপোরেশনের সেবা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হাসপাতাল ভবন। সংঘটিত ভূমিকম্পে বঙ্গোপসাগরের গভীরে ঘটতে পারে ভূমিধেরস মতো ঘটনা। আর সাগরতলের ভূমিধসে সুনামি সৃষ্টি একটি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
স্থপতি ও নগর-পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর ভবন ও স্থাপনার শতকরা ৯০ ভাগই নক্সা বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে তিনি দাবি করেন নগরীর প্রায় ৭৮ শতাংশ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ।
দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের (সিডিএমপির) এক রিপোর্টেও বলা হয়েছে, উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পে চট্টগ্রামের ১ লাখ ৮৪ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড-১৯৯৩ অনুসরণ করে ভূমিকম্প প্রতিরোধী নিয়ম প্রয়োগ করলে ভবন নির্মাণ খরচ মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। অথচ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানসহ বেশকটি শহর ও শহরতলীতে নির্বিচারে পাহাড় ও টিলা কেটে অথবা পুকুর-দীঘি ভরাটের মাধ্যমে বাড়িঘর ও ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বললে তারা জানান, মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি দিয়ে চলছে ফায়ার সার্ভিস। কোনো উঁচু ভবন বা সাধারণ বড় অগ্নিকাণ্ডে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো কোনো যন্ত্র নেই আমাদের কাছে। আর ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ মোকাবিলা তো প্রায় অসম্ভব।
গবেষণায় দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর তীরসংলগ্ন অধিকাংশ এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু বৃহদাকার স্থাপনা। যার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য কিছু হলো চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, শাহ আমানত বিমানবন্দর, ইস্টার্ন রিফাইনারিস আরও বেশি কিছু প্রতিষ্ঠান। যা সম্পূর্ণভাবেই বেলে মাটির উপর অবস্থিত।
ভূমিকম্পের সময় এসব প্রতিষ্ঠান ও ভবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । এছাড়াও কোনো পেট্রোকেমিক্যাল স্থাপনায় আগুন লাগলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় ও প্রতিষ্ঠানে এবং আমাদের দেশের রাস্তা গুলো অপ্রসস্থ হওয়ায় উদ্ধার কাজে ও লাগতে পারে মাত্রাতিরিক্ত সময় ফলে বেড়ে যেতে পারে হতাহতের সংখ্যা। এছাড়াও ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে কর্ণফুলীর উপর নির্মিত শতবর্ষ বয়সী কালুরঘাট সেতুটি। যার ফলে বিচ্ছিন্ন হতে পারে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ। এছাড়াও বড় ভূমিকম্প বা সুনামির সময় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
ইউএসটিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর ১ হাজার ৩৩টি স্কুলের মধ্যে ৭৪০টি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে। এছাড়াও নগরের অনেক স্কুলভবনই টেকসই নয়। বিভিন্ন ভবনের নিচের তলায় গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় ভাড়া নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন স্কুল।
ভূমিকম্পের ঝুঁকি ও বিপদ প্রসঙ্গে সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগীয় প্রধান ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম আলী আশরাফ বলেন, ভূমিকম্পে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার বেল্ট বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূ-পাটাতনের (টেকটোনিক প্লেট) একটি ফাটল বা ফল্ট লাইন চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূল হয়ে আন্দামান পর্যন্ত চলে গেছে। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ নগরায়ণ ভূমিকম্প দুর্যোগে বিপদের প্রধান কারণ। এ অঞ্চলে মাঝারি-শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে অধিকাংশ ভবন টিকবে না। নগরির প্রায় ৭০ শতাংশ ভবনই ধ্বুলিস্শাত হয়ে পড়বে।
খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা জরিপ মতে, চট্টগ্রামের প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্যিক ভবন ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার মধ্যে ভূমিকম্প সংঘটিত হলে সেসব ভবন কম-বেশি বিধ্বস্ত হতে পারে।
বাংলাধারা/এআই