শৌখিন খাবারের মোড়কে চলছে প্রকৃতির নির্মম হত্যাযজ্ঞ। নামি-দামি রেস্তোরাঁয় ‘এক্সক্লুসিভ ডিশ’ হিসেবে পরিবেশিত হচ্ছে ‘বাদামি তিতির রোস্ট’, ‘জংলি কোয়েল কারি’ কিংবা ‘বন মুরগির ঝাল ফ্রাই’। কিন্তু এই লোভনীয় নামের আড়ালে প্রতিদিন অবৈধভাবে শিকার হচ্ছে শত শত পাখি। মানুষের রসনা তৃপ্তির জন্য নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের মূল্যবান সম্পদ!
আনোয়ারায় ৬৯৭ পাখি জবাই, গ্রেপ্তার ৩
সাম্প্রতিক এক ঘটনায়, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ভয়ংকর এই অবৈধ কার্যক্রমের প্রমাণ মিলেছে। ৬৯৭টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি জবাই করে বস্তাবন্দি অবস্থায় পাচারের সময় পুলিশ আটক করেছে তিনজনকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে উদ্ধার হওয়া এসব পাখির মধ্যে ছিল বিভিন্ন বন্য প্রজাতির দুর্লভ পাখি। যা চলে যেতো নামি-দামি রেস্তোরাঁয় বিশেষ ক্রেতাদের প্লেটে।যেখানে এগুলো ‘ মুখরোচক ডিশ’ হিসেবে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়।
পাখি হত্যার ভয়ংকর নেটওয়ার্ক
একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধারে দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চল ও জলাভূমি থেকে পাখি শিকার করে আসছে। গোপন সূত্রে জানা গেছে, এই চক্রের সদস্যরা প্রথমে ফাঁদ ও বিষ ব্যবহার করে পাখি ধরছে, তারপর বিশেষ কৌশলে সেগুলোকে বাজারজাত করছে। প্রথমে ছোট আড়ত, সেখান থেকে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে এবং পরবর্তীতে বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় পৌঁছে যায় এসব পাখির মাংস।
এই চক্রের শেকড় আরও গভীরে— দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাখি শিকারের গোপন স্পট তৈরি হয়েছে, যেখানে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে পরিযায়ী ও দেশীয় দুর্লভ প্রজাতির পাখি।
সিন্ডিকেটের নৃশংস চিত্র: পাখি থেকে প্লেটে পৌঁছানোর গোপন চক্র
একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধারে দেশজুড়ে পাখি শিকার ও পাচারের ভয়ংকর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। সাধারণ গ্রাম্য শিকারিদের ব্যবহার করে তারা পরিযায়ী ও দেশীয় পাখি শিকার করায়। এরপর গোপন আড়তে এনে সেগুলো সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
কোথায় শিকার হয়?
সুন্দরবন, হাওর অঞ্চল, উপকূলীয় এলাকা ও নদী-নালা সংলগ্ন এলাকায় সবচেয়ে বেশি পাখি শিকার হয়। শীতকালে বাংলাদেশে আসা পরিযায়ী পাখিরা এ চক্রের প্রধান লক্ষ্য।
কীভাবে পাচার হয়?
পাখিগুলো গোপনে বস্তাবন্দি করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে পাঠানো হয়। কখনো বাস-ট্রাকের নিচে লুকিয়ে, কখনো ফলের ঝুড়িতে চাপা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এসব নিষিদ্ধ মাংস।
মূল হোতারা কারা?
গ্রাম থেকে পাখি সংগ্রহ করা শিকারিরা এই চক্রের নিচের স্তরে কাজ করে। আসল নিয়ন্ত্রকরা শহরের বড় ব্যবসায়ী, রেস্তোরাঁ মালিক এবং কিছু অসাধু সরবরাহকারী। পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, এই পাচার চক্রের মূল পরিকল্পনাকারীরা সাধারণত ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
শিকারে প্রযুক্তিগত ব্যবহার
পরিযায়ী পাখি শিকারের জন্য এবার শিকারিরা প্রযুক্তির ফাঁদসহ অভিনব কৌশল ব্যবহার করছে। যে কারণে এ অঞ্চলে পরিযায়ী পাখির বিচরণ ক্ষেত্রগুলো ক্রমশ তাদের মরণ ফাঁদে পরিণত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অতীতে মাছ ও ফড়িং দিয়ে ফাঁদ পেতে, কীট-পতঙ্গের সাথে কীটনাশকের বিষটোপ দিয়ে, খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে, বড়শি ও কারেন্ট জালের ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করা হতো।
বর্তমান প্রযুক্তির যুগে পাখি শিকারি চক্র প্রযুক্তির সহায়তায় পাখিদের বোকা বানিয়ে সহজেই তাদেরকে শিকার করেছে। তারা ওই সব পাখির শব্দ বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে আগে সংগ্রহ করে রাখে করে পোর্টেবল সাউন্ড-বক্সে ঢুকিয়ে রাখে। যেখানে পাখিদের আনাগোনা বেশি, সে সব বিল ও জলাশয়ের বৃহৎ এলাকা জুড়ে জালের ফাঁদ পেতে রাখে। তার মাঝখানে ওই পোর্টেবল সাউন্ড-বক্সে পাখির ডাক বাজানো শুরু করে। আর ওই ডাক শুনে সতীর্থদের নিরাপদ অবস্থান মনে করে পাখিরা শিকারির নানা ফাঁদের মধ্যে নামতে শুরু করে। আর ওখানে নামলেই পাখিরা ফাঁদে আটকে যায়।
জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়ংকর হুমকি
পরিবেশবিদরা বলছেন, পাখি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, পরাগায়ন বৃদ্ধি ও বনায়নের বিস্তারে পাখির গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ এই অবৈধ শিকারের ফলে প্রকৃতির শৃঙ্খলা ভয়াবহভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশেষ করে, যে-সব পরিযায়ী পাখি প্রতিবছর হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে, তাদের নির্বিচারে শিকার এই প্রাকৃতিক চক্রকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলছে।
আইনের প্রয়োগ কোথায়?
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১২ অনুযায়ী, বন্যপ্রাণী শিকার, পরিবহণ, বিক্রি ও সংরক্ষণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দোষী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১ থেকে ৩ বছর কারাদণ্ড এবং মোটা অঙ্কের জরিমানা হতে পারে। কিন্তু যথাযথ নজরদারি ও আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে এই নিষ্ঠুরতা থামছে না।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, শুধুমাত্র পুলিশের কয়েকটি অভিযান যথেষ্ট নয়, বরং প্রশাসনের কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি, যাতে তারা এসব অবৈধ খাবার বর্জন করেন।
কবে থামবে এই পাখি হত্যার মহোৎসব?
প্রশ্ন থেকে যায়—এই নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়? যদি এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আগামী দিনে বাংলাদেশ হারাতে পারে বহু মূল্যবান পাখির প্রজাতি। শুধু আইন প্রয়োগ নয়, প্রয়োজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। নয়তো একদিন প্রকৃতির এই রত্ন আমাদের মাঝ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে।
প্রাণিকল্যাণ সংগঠন পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ার (পিএডব্লিউ) ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্থপতি রাকিবুল হক এমিল বলেন, আমি একজন প্রাণী অধিকার কর্মী হিসেবে আমি বলবো আমাদের আমিষের চাহিদা একটু লিমিট করতে পারলেই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আমাদের প্রাকৃতিক জন্যও ভালো।এটা বন্ধ করার জন্য প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর স্বাস্থ্য বিভাগ এবং আমাদের পরিবেশ বিভাগ এই তিনটি দপ্তরকে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।যাতে মানুষ কোন ভাবে বন্য প্রাণী নিধন না করেএভাবে বন্য প্রাণী যদি হত্যা করা হয় সে গুলার সংরক্ষণ বা আমাদের বন্য প্রাণী হারিয়ে যাওয়া সে গুলা ত কিছু বিষয় আছেই তার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য একটি বড় বিষয় রয়েছে। আমরা যে আমিষের উপর নির্ভরশীল তা থেকে পাখিগুলোকে একটু মুক্ত করা উচিত। সেক্ষেত্রে আমরা কিছু নির্দিষ্ট রাখি হাস, মুরগি, গরু ছাগল তো রয়েছেই।
বন্যপ্রাণী খাওয়া স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায় জানিয়ে তিনি আরও বলেন বন্য প্রাণী অনেক ধরনের রোগ বহন করতে পারে কারণ ও কি খাচ্ছে কোথায় কোথায় যাচ্ছে ওর শরীরে কি বহন করছে সেটা আমরা জানিনা এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য একটা বিশাল হুমকির ব্যাপার। যেমন খেজুরের রস ডাকা থাকে নাকি খোলা থাকে এটার জন্য খেজুরের রস খাওয়া অনেক কমে গেছে মানুষের কিছু ভয়ের কারণে।বন্য প্রাণী খাওয়ার বিষটা এজন্য জনস্বাস্থ্যের জন্য বেশি হুমকির ব্যাপার।