কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৩’তে সপ্তাহের ব্যবধানে ফের অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় দুঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুণ নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার আগে প্রায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর আগে ২৪ মে আরেক অগ্নিকান্ডে পুড়েছে ৫ শতাধিক বসতি-দোকান ঘর।
বারবার ঘটা অগ্নিকাণ্ডকে নাশকতা বলে দাবি করছেন সাধারণ রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা। তাদের দাবি, ক্যাম্পে প্রভাব বিস্তার করতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো পরিকল্পিতভাবে এই আগুন লাগাচ্ছে। অনেকে আবার আগুন লাগানোর ঘটনার সাথে বেশ কিছু এনজিও সংস্থা জড়িত বলে দাবি করেছেন।
আগুন লাগার ঘটনাটি পরিকল্পিত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ৮ এপিবিএন অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমীর জাফর।
কিন্তু আগুণের সূত্রপাত কোথা হতে, তার সঠিক কোন তথ্য দিতে পারছে না দমকল বাহিনী।
উখিয়া ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক কামাল হোসেন বলেন, কিভাবে আজকের এবং পূর্বের আগুনের সূত্রপাত হয়েছে তা সুনিশ্চিত করে এখনো বলা যাচ্ছেনা। তদন্তের পর আগুন লাগার বিষয় ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বলা যাবে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারদিকে পাহাড় আর সরু রাস্তা। নেই পর্যাপ্ত পানির সরবরাহের ব্যবস্থা কিংবা পানির উৎস। এমন পরিস্থিতিতে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। ফলে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা যাচ্ছেনা।
সাধারণ রোহিঙ্গাদের মতে, গেল ২৪ মে একই ক্যাম্পে দিন দুপুরে আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে প্রায় তিন শতাধিক বসতি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরো ২ শতাধিক বসত ঘর ও অর্ধ-শত দোকানপাট। সে ঘটনায় এখনো খোলা আকাশের নিচে দিনযাপন করছে সহস্রাধিক রোহিঙ্গা। এরই মধ্যে শনিবার (১জুন) দুপুরে আবারও ক্যাম্প ১৩-তে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। নিয়ন্ত্রণে আসার আগে আগুনে পুড়ে গেছে প্রায় দুই শতাধিক বসতি। আংশিক ক্ষতি হয়েছে আরও অর্ধশত।
বারবার আগুন লাগার ঘটনাকে রহস্যজনক বলে মনে করেন তারা। তাদের অভিযোগ আগুন লাগার ঘটনা তদন্ত করা হলেও প্রকাশ্যে আসেনা তদন্ত রিপোর্ট। আর অপরাধীদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় নাশকতার ঘটনা বারাবার ঘটছে। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ রোহিঙ্গাদের।
রোহিঙ্গাদের দেয়া তথ্য মতে, সম্প্রতি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আরকান আর্মির সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘাতের পর রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসা, আল-ইয়াকিন, আরএসওসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা ক্যাম্পে অবস্থান করছে। এরপর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প দিন দিন উত্যপ্ত হয়ে উঠে। ক্যাম্প নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে খুনোখুনির পাশাপাশি নাশকতার চেষ্টা করছে তারা। এরইমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। এসময় গ্রেফতার করা হয়েছে সংগঠনগুলোর অনেক সদস্যকে। এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ কম থাকা ক্যাম্পে আগুন দিচ্ছে অপরাধীরা। শুক্রবার (৩১ মে) রাত ৯টার দিকে শফিউল্যাহ কাটা পুলিশ ক্যাম্পের টহল দল ১৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি/৮ ব্লকে ওয়ার্ল্ড ভিশন মাঠে গেলে গুলিশের উপর অতর্কিত হামলা চালায় সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা। এতে এক পুলিশ সদস্য জখম হয়েছে।
ক্যাম্প-১৩ বি-ব্লকের বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, যে ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ নেই তারা সেখানে গিয়ে আগুন দিয়ে পালাচ্ছে। তারা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে নিতে অপরাধ করছে। আর আমরা সাধারণ রোহিঙ্গারা কষ্ট পাচ্ছি।
রহমত উল্লাহ, আয়াছ ও করিম এমদাদ নামে অপর রোহিঙ্গারা বলেন, ক্যাম্পে অনেকগুলো গ্রুপ আছে। সন্ধ্যা হলেই পুরো ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সশস্ত্র গোষ্ঠির হাতে। এসব গ্রুপের সদস্যরাই অস্থিরতা তৈরি করতে ক্যাম্পে একের পর এক আগুন লাগাচ্ছে।
এদিকে শনিবার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ইছহাক নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, বসতি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিছুই বের করতে পারেনি।
রবিউল বলেন, আগুন সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কি করবো বুঝে আসছে না।
তারা দুজনসহ আরো অনেক রোহিঙ্গা বলেন, কয়েকদিন আগের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখনও খোলা আকাশের নিচে বাস করছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। নেই পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা ও বিশুদ্ধ পানি। এখন আবারও আগুনের ঘটনায় আমাদের মনে আতংক তৈরি হয়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে থাকবেনা। যতদিন ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘরগুলো তৈরি করা হচ্ছেনা ততদিন তারা আশেপাশে তাদের নিকট আত্মীয় স্বজন ও বিভিন্ন সংস্থার সেল্টারগুলোতে অবস্থান করবে। খাবার নিয়ে এখনো কোন সমস্যা তৈরি হয়নি। আশা করি হবেও না। নাশকতার বিষয়টি শোনতে পাচ্ছি। বিষয়টি নিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করবে আশা করি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা ৮ এপিবিএন’র অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমীর জাফর বলেন, আগুন লাগার ঘটনা নাশকতা এ কথাটি আমাদের কানেও এসেছে। আমরা কথাটি একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছিনা। বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা কাজ করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গন্ডগোল শুরু হলে তার ছোঁয়া এপারেও লাগে। ওপারের অপরাধীরা গোপনে ক্যাম্পে আসেনি সেটি আমরা বলছিনা। আমরা সব এজেন্সির সাথে সমন্বয় করে কাজ করছি। কোন অবস্থায় অপরাধীদের ছাড় দেয়া হবেনা। #
