পাহাড়ের একের পর এক অপহরণ ও গুম হয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীদল আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা। গত কয়েক বছরে শুধুমাত্র রাজস্থলী উপজেলাতেই একের পর এক অপহরণ-গুম ও হত্যার শিকার হয়েছে আওয়ামীলীগের অন্তত অর্ধডজন নেতাকর্মী।
অপহরণের স্বর্গরাজ্য এই উপজেলায় গুলি করে হত্যাসহ অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর কয়েক মাস/বছরেও ফিরে আসেনি রাজস্থলী উপজেলার প্রথমসারির আ’লীগ নেতা, ছাত্রলীগ নেতা, যুবলীগকর্মীসহ অঙ্গসহযোগি সংগঠনের একাধিক নেতাকর্মী শুধুমাত্র আওয়ামী রাজনীতি করার অপরাধে উপজাতীয়দের আঞ্চলিকদলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে অপহরণ-গুম খুনের শিকার হয়েছে।
আঞ্চলিকদলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে সর্বশেষ রোববার ২৩শে জুন অপহরণের শিকার হয়েছেন রাজস্থলী উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি হ্লা থোয়াই অং মারমা ওরফে গঞ্জ মারমা। তিনি বাঙ্গালহালিয়াস্থ কাকড়াছড়ি এলাকার বাসিন্দা। রাজস্থলী উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান উবাচ মারমা অপহরণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয় কারবারি সুই ক্যাচিং মারমা জানিয়েছেন, রোববার বিকেলে নিজবাড়ি থেকে বের হয়ে জরুরী কাজে কাকড়াছড়ি বাজারে আসার সময় হ্লা থোয়াই অং ওরফে গঞ্জ মারমাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে ভেতরের পার্টির লোকজন। এখনো পর্যন্ত তাকে কোথায় রাখা হয়েছে এবং কি অবস্থায় আছে সে ব্যাপারে কোনো খোঁজ মেলেনি।
কারবারি জানান, অপহৃতের এক ছেলে মালয়েশিয়ায় আর এক মেয়ে থাকে চট্টগ্রামে। অপহৃতের স্ত্রী অসহায় অবস্থায় আছে তাই থানায় কোনো অভিযোগ দাখিল করেনি। এই ঘটনার পরপর উক্ত এলাকার আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে চন্দ্রঘোনা থানার অফিসার ইনচার্জ আনসারুল করিম জানিয়েছেন, আমরা ঘটনাটি শুনার পরপরই উক্ত অপহৃতের স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করে অভিযোগ দেওয়ার জন্য বলেছি; কিন্তু তারা কেউই অভিযোগ দেয়নি। তারপরও পুলিশ উক্ত বিষয়টি খতিয়ে দেখে কে বা কারা এই ঘটনায় জড়িত সেটি বের করার চেষ্ঠা করছে।
স্থানীয়রা জানায়, রাজস্থলী উপজেলায় আ’লীগের নেতাকর্মীরা চরম উৎকন্ঠার মধ্যে দিনানিপাত করছে। আঞ্চলিকদলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে চলতি ২০২৪ সালের ৭ই এপ্রিল সকালে বাঙ্গালহালিয়া ইউপি’র ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার ক্যাচিংহ্লা মারমা (৩৪) ও ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার ইখ্যাইমং মারমা (৩৬)কে বাজারে আসার পথে অপহরণ, ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর সকালে ঘিলাছড়ির আমতলীপাড়া থেকে রাজস্থলী উপজেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাউদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর এখনো পর্যন্ত তাদের খোঁজ পায়নি পরিবার ও প্রশাসন।
২০২৩ সালের ১২ই জুন সোমবার গাইন্দ্যা ইউপি’র লংগদুপাড়া থেকে অস্ত্রের মুখে দুই ভাইসহ তিন শ্রমিককে অপহরণ, ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর সকালের দিকে মংচিংসা মারমাকে অপহরণ, ২০২০ সালের ৯ই জানুয়ারীতে গবছড়ায় গুলি করে হত্যা করা হয় বাসিমং মারমাকে। ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর বুধবার ভোর রাতে কাকঁড়াছড়িতে অংসু অং মারমাকে গুলি করে হত্যা, ২০১৯ সালের ১৯শে মে বাঙ্গালহালিয়ার ৮নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ক্য হ্লা চিং মারমা (৪০)কে গুলি করে হত্যা করে আঞ্চলিকদলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
এদিকে, দীর্ঘ তিন মেয়াদে ক্ষমতার থাকার পরেও রাজস্থলীতে আ’লীগের নেতাকর্মীদের কচু কাটার মতো করে অপহরণ করে নিয়ে গুম করে ফেলা, প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করার মতো ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটলেও দলটির উপজেলা বা জেলার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের শক্ত পদক্ষেপ না নেওয়ায় নেতাকর্মীদের মাঝে বিরাজ করছে চরম ক্ষোভ ও হতাশা।
তৃণমুল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দলের উপজেলা সভাপতির সাথে আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের ব্যক্তিগত আতাঁত থাকায় তিনি অপহৃত নেতাকর্মীদের বিষয়ে আন্দোলনে নামতে আগ্রহী নন। বিষয়টি নিয়ে সোমবার বিকেলে তার সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি পরে ফোন করবেন জানিয়ে ফোন রেখে দেন।
রাজস্থলী উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও গাইন্দ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পুচিংমং মারমা বলেন, রাজস্থলী উপজেলায় আমাদের আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের করুন অবস্থা। আঞ্চলিকদলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে পুরো রাজস্থলীবাসি জিম্মি মন্তব্য করে পুচিংমং বলেন, একাধিকবার আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। আমি উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরেও উপজেলা সদরের এক কিলোমিটার সীমানার মধ্যেই চলাফেরা করতে হয়। প্রাণনাশের ভয়ে এর বাইরে যেতে পারিনা। তিনি বলেন, সাধারণ নেতাকর্মীরা প্রতিনিয়তই সন্ত্রাসীদের হাতে মারধরে পাশাপাশি অপহরণ গুমের শিকার হলেও দলের পক্ষ থেকে একদিন বিক্ষোভ মিছিল বা শোক সমাবেশ করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়। এরপর আর কোনো খবর কেউই রাখেনা। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্মের পাহাড়ি সন্তানরা রাজস্থলী আওয়ামীলীগের পতাকাতলে আসবেনা এবং দল অদূর ভবিষ্যতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
এদিকে, রাজস্থলীতে একের পর আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী অপহরণ-গুম খুনের শিকার হওয়ার পরেও সংগঠনটির উপজেলা নেতৃবৃন্দ ধারাবাহিক কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেনা তৃণমুল নেতাকর্মীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মূছা মাতব্বর প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের পুরো বিষয়টি উপজেলা আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে জানানো হয়নি। এই বিষয়ে আমি আমাদের দলীয় সভাপতির সাথে আলাপ করে করণীয় নির্ধারণ করবো।