আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান »
‘ঘাম ঝরে দরদর, গ্রীষ্মের দুপুরে/ খাল বিল চৌচির, জল নেই পুকুরে… পিপাসায় পথিকের, ছাতি কাঁপে দুদ্দুর’— ফজলুর রহমান রচিত ‘গ্রীষ্মের দুপুরে’ কবিতার ছন্দ নয় শুধু বাস্তবে এই গ্রীষ্মের দুপুরে খররোদে পথিকরা পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ে পাহাড়ি জনপদেও। সে যদি হয় পাহাড়ি রাস্তার পথিক, তাহলেতো আরও করুণ। পার্বত্য জেলা রাঙামাটি থেকে বান্দরবান ফেরার পথের তৃষ্ণা মেটানো জন্য দাড়িয়েছিলাম ক্যমলং নামে একটি গ্রামে। রাস্তার পাশে দেখালাম ক্লান্ত পথিক ও পাহাড়ি শ্রমিকরা তৃষ্ণা মেটাতে ভিড় করেছেন ‘চেরাই ঘরে’।
পাহাড়িদের ‘চেরাই ঘর’ নিয়ে কথা হয়েছিল ক্যামলং পাড়াবাসী খেই সাং উ মার্মা (৫৫) সাথে। তিনি জানান, এটি মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। মারমা ভাষায় বলা হয় ‘চেরাই ঘর’ ঘর। অর্থাৎ বিশ্রাম নিবাস। এটি বহুকাল থেকে প্রচলিত।
জানা গেছে, এক স্থান থেকে দূরে অন্য স্থানে যাওয়ার পথে বটগাছের তলে এ ঘরের দেখা মিলে। পূর্বে যখন যানবাহনের চল ছিল না কিংবা পায়ে হাটা ছাড়া কোন উপায় ছিল না তখন মানুষ প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে দূরে অন্য জায়গায় পায়ে হেটে যেতো। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত-শ্রান্ত তখন একটু বিশ্রাম কিংবা পানি পানে তৃঞ্চা মিটিয়ে বিশ্রাম নিয়ে থাকে। সেখানে ছোট্ট একটি ঘরের হাল্কা উঁচুতে রাখা থাকে ঠাণ্ডা পানি ভর্তি তিন-চারটি মাটির কলসি। যে কেউ এই তপ্ত রোদে পানি তৃষ্ণা মেটাতে পারে। পিপাসার্ত পথিক কিংবা পাহাড়ি শ্রমিক বিশ্রাম নিবাসও বলা হয় এটিকে।

ক্যমলং পাড়াবাসী মংছো মার্মা (৬৫) বলেন, আদিকালে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা মাটির কলসিকে আধুনিক কালের ফ্রিজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতেন। মাটির কলসির মধ্যে পানি রাখলে চৈত্র মাসে পানি ঠাণ্ডা থাকে। তাই মানবিক তাড়নায় মাটির কলসি ভর্তি পানি রাখা হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বান্দরবান সদর উপজেলার অন্তর্গত শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ক্যামলং পাড়া। বান্দরবান-রাঙামাটি সড়কের পাশে দুটি বড় অশ্বত্থ গাছের মাঝখানেই এই ‘চেরাই ঘর’। পাশাপশি জয় মোহন পাড়া, জামছড়ি ইউনিয়নের জামছড়ি মূখ পাড়া, কুহালং ইউনিয়নের থোয়াইঙ্গ্যা পাড়া, ক্যামলং পাড়াসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো এই মানবতার ঘর দৃশ্যমান। বিশেষ করে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে কিংবা বর্ষাকালে পথচারীদের অনেক উপকারে আসে বলে জানা যায়। সেই ঘরে বিশ্রাম নিতে ও তৃষ্ণা মেটাতে মাটির তৈরির দু’টি কলসি রয়েছে। শত শত মানুষের তৃঞ্চা মেটায় এবং সাধারণ মানুষের চলাচলরত ঝড়বৃষ্টি থেকেও এই ঘর নিরাপদ রাখে ক্ষণিকের জন্য।

জামছড়ি পাড়াবাসী মিথুই চিং মার্মা (৪৫) বলেন, ২-৩ দিন পর পর কলসিতে পানি ভরে দিতে হয়। যাতে পথিকরা তৃষ্ণার মেটাতে পারে। কেননা মানুষ মৃত্যুের পথযাত্রীকেও পানি দেয়। শুধু তাই নয় তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি খাওয়ালে অনেক পূণ্য হয়।
স্থানীয়দের মতে, এই ‘চেরাই ঘর’ তৈরি করে ক্লান্ত পথিকের ঠাণ্ডা পানি দিয়ে পিপাসা মিটানোসহ রোদ ঝড় বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে মারমা জনগোষ্ঠীদের পাড়ায় দেখা মেলে এরকম পানি ভর্তি কলসিসহ ছোট্ট ঘর। মারমাদের বিশ্বাস— কোন ক্লান্ত, শ্রান্ত, তৃষ্ণার্ত পথিক এই ঘর থেকে পানি পান করলে যেই ব্যক্তি এই মহৎ কাজটি করেছেন তিনি ধর্ম, পূণ্য, আর্শীবাদ পাবেন কাজটির জন্য। কারণ কলসির ভিতর শুধু ঠাণ্ডা পানি নয় গভীর মমতায় মানবতাও থাকে।

২নং কুহালং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সানু প্রু মার্মা (৭৫) বলেন, এই ‘চেরাই ঘর’ ঘর তৈরি করে পথচারীদের সাময়িক বিশ্রাম ও তৃঞ্চা মেটানোর কাজটি কবে থেকে শুরু হয়েছে সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও অনুমান করা যায় এই সংস্কৃতি প্রচলন শত শত বছর আগে— এতে কোন সন্দেহ নেই।
হ্নারা মৌজার হেডম্যান ও বান্দরবান সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান রাজু মং মার্মা বলেন, ‘লামা, আলিকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রুমা, রোয়াংছড়ি, থানছি বান্দরবান জেলার ৭ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো পূণ্যের আশায় পাহাড়ের মানুষরা এই ‘চেরাই ঘর’ তৈরি করে পানীয় জল ও ক্ষণিকের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে থাকে।’
বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক মংনুচিং জানান, ‘চেরাই ঘর’ এটি মারমাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি। সংস্কৃতির বিলুপ্তি হলেও কিছু কিছু সংস্কৃতি এখনো প্রচলিত রয়েছে। এটি পূর্ব পুরুষ থেকে প্রাপ্ত। তবে কখন থেকে প্রচলিত সেটি বলা যাচ্ছে না।