আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান »
বান্দরবানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুর্গম এলাকায় বসবাসরত ভূমিহীন ২৩০টি পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার পাচ্ছে বাশের আদলে তৈরি ঐতিহ্যবাহী ‘মাচাং ঘর’। পাহাড়ের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তৈরি করা হয়েছে এসব মাচাংঘর। পরিবেশবান্ধব বাঁশ, কাঠ, টিন ও ছন দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে নির্মিত এসব ঘর। যা ঘর তৈরি নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৬৭০ টাকা।
পাহাড়ের বসবাসরত এসব জনগোষ্ঠীরা জানান, আদিকাল থেকেই বংশ পরম্পরায় বাঁশ কাঠের মাচাংঘরেই বসবাস করে আসছে এসব জুমিয়ারা। মাচাং ঘরে থাকতে একদিকে যেমন সুবিধা তেমনি মাচাং ঘরের নিচে বিভিন্ন গৃহপালিত পশু পালন এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রাখার সুবিধা রয়েছে। এছাড়াও মাচাংঘর ভূমি থেকে উঁচুতে হওয়ায় বিভিন্ন পোকামাকড় ও জীব জন্তুর আক্রমণ থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। বিশেষ করে এটি পাহাড়ের সংস্কৃতি হিসেবে এটি তাদের ঐতিহ্য ঘর। যা পাহাড়িদের কাছে অত্যান্ত জনপ্রিয়। তাই নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাসের পাহাড়িদের জন্য সেমিপাকা ঘরের পরবর্তীতে মাচাংঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর।
জানা গেছে, ভূমিহীন পরিবারের জন্য গৃহনির্মাণ প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ের আওতায় বর্তমানে বান্দরবান সদর উপজেলায় ৯টি, আলীকদম উপজেলায় ১টি, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ১৫টি, রোয়াংছড়ি উপজেলার ৪৫টি, লামা উপজেলায় ১৫টি, রুমা উপজেলায় ১০০টি এবং থানছি উপজেলায় ৪৫টি মাচাংঘর নির্মিত হচ্ছে। এর আগে গৃহনির্মাণ প্রকল্পের সেমিপাকা করলেও সেটি নিয়ে নানান অভিযোগও শেষ ছিল না। একে পর টাকা পরিবার থেকে টাকা নেওয়া, নিম্ন সামগ্রী দিয়ে ঘর তৈরিসহ ইত্যাদি। তাই পাহাড়ের প্রকৃতি সাথে মানিয়ে নিতে মাচাং ঘর তৈরি প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসে সরকার।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি জানান, জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে এবং এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে এসব মাচাং ঘর নির্মাণের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি প্রতিনিধিদল বান্দরবান পরিদর্শন শেষে মাচাংঘর নির্মাণের যৌক্তিকতা বিবেচনায় এনে বিষয়টি অনুমোদন করে। তার ধারাবাহিকতায় বান্দরবানের পাহাড়ি পল্লীতে এ মাচাংঘর তৈরি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, মাচাং আকৃতি ঘরগুলো পরিবেশবান্ধব। স্থানীয় প্রযুক্তি আর মালামাল ব্যবহার করে এটি বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি। এখানকার মানুষের জন্য ঘরগুলো নির্মাণ করা অত্যন্ত সহজ বলেও মত দেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জামছড়ি ইউনিয়নের তিনটি ঘর সম্পন্ন হয়ে ঘরের উঠানে ভূমিহীন পরিবার শুরু করে জীবনযাপন। মাটি থেকে ২ ফুট উপরে মাচাং ঘরের উচ্চতা। এছাড়াও থানচি দুর্গম এলাকার রেমাক্রী ইউনিয়নের ২২টি মাচাং ঘরের চলছে পুরোদমের কাজ। কাজের মান প্রায় ৯০ শতাংশ শেষে পর্যায়ের। ঘরের চতুর্পাশে শুরু করেছে রঙ লাগানোর কাজ। কয়েকদিন পর ঘরের কাজ সম্পন্ন শেষে নতুন মাচাং ঘরে উঠতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ভূমিহীন পরিবারগুলো।
বান্দরবান রোয়াংছড়ি সড়কে হাংসামা পাড়া য়ইনুপ্রু মারমা, অংসাচিং মারমা, পাই নু মারমা সহ উপকারভোগীরা বলেন, আমরা কোন রকম ভাঙা ঘরে দিনাতিপাত করতে হয়েছিল। এবার প্রধানমন্ত্রী উপহার ঘর পেয়ে অত্যন্ত খুশি।
দুর্গম থানচি রেমাক্রী এলাকা হতদরিদ্র জুম চাষীনী ম্রাখয় সা মারমা বলেন, যারা দুর্গম পাহাড়ে জুমের চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন, তারা অত্যন্ত নিম্ন আয়ের মানুষ। কোন রকম বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হয় প্রতিনিয়ত। প্রধানমন্ত্রী দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠীদের দুই মুঠো খেয়ে মাথা গোঁজার জন্য স্থান করে দিয়েছেন।
বান্দরবান সদর উপজেলার জামছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যসিংশৈ জানান, জামছড়ি ইউনিয়ন পরিষদে সর্বপ্রথম মডেল হিসেবে নির্মিত হচ্ছে মাচাংঘর। যেটি প্রত্যন্ত এলাকার পাহাড়ি জনগণ সেমিপাকা ঘরের চেয়ে মাচাংঘরকে বেশি পছন্দ করেন। এতে মাচাংয়ের নিচে গৃহপালিত পশু পালনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সারা বছর সংরক্ষণ করা যায়। তবে একটি টেকসই মাচাংঘর নির্মাণের জন্য কমপক্ষে চার লাখ টাকা বরাদ্দ করা প্রয়োজন।
থানচি রেমাক্রী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা বলেন, একমাত্র নৌ পথ দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। এরকম দুর্গম এলাকাগুলোতে সেমিপাকা ঘর নির্মাণে মালামাল (ইট, সিমেন্ট, রট) পৌছানো জন্য অতিরিক্তি খরচ বহন করতে হবে। সেই দিক দিয়ে বর্তমানে যে মাচাং ঘর দিচ্ছে পাহাড়ের জন্য অত্যন্ত যুগোপযোগী।
জেলা প্রশাসন দেওয়া তথ্য মতে, বান্দরবানে ১ম থেকে ৩য় ধাপে ৪ হাজার ১৩৩টি ভূমিহীন পরিবারের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গৃহনির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৫৬০টি গৃহনির্মাণের জন্য ৭০ কোটি ৩৩ লাখ ৭ হাজার ১শ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে ২ হাজার ৯৬৮টি সেমিপাকা ঘর ভূমিহীন পরিবারের মাঝে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে ২৩০টি মাচাংঘরসহ সর্বমোট ৫৯২টি গৃহ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে।