চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং কর্ণফুলী দুই উপজেলায় অবস্থিত কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) এখন পরিবেশের জন্য বড় বিপর্যয়। নতুন কারখানা তৈরির অজুহাতে নির্বিচারে ধংস করছে টিলা ও পাহাড়, যা পরিবেশের জন্য মারাত্নক ক্ষতি। একসময় পাখির ডাক, সন্ধ্যা গড়াতেই দূর থেকে হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর শব্দে মুখরিত থাকতো এই অঞ্চল। সম্প্রতি অনিয়ন্ত্রিত ভাবে কাটা পাহাড়ে প্রাণ গিয়েছে দুই শিশুর।
দীর্ঘ ৭ বছর হাতির আবাস নষ্ট হয়েছিল বলেই লোকালয়ে হামলা করেছিল কেইপিজেডে থাকা হাতির দল। বিগত ৭ বছরে লোকালয়ে হাতির আক্রমণে বৃদ্ধ ও শিশুসহ নিহত হয়েছে প্রায় ২০ জন।।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন,১৯৯৫ ধারা ৬ এর (খ) স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কতৃর্ক সরকারী বা আধা-সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না। বিগত ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কেইপিজেডকে দেওয়া ছাড়পত্রে লিখা আছে যে প্রয়োজনে শুধুমাত্র পাহাড় মোচনের অনুমতি আছে কিন্তু পাহাড় কাটার অনুমতি নেই। এরপরও দেশের প্রচলিত আইনকে অমান্য করে দেয়াং পাহাড়কে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ ধ্বংস করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।পাহাড় কাটা বন্ধ করতে কেইপিজেডকে হাইকোর্ট নির্দেশনাও দেন। কিন্তু সময় ও সুযোগ বুঝে তারা আবারো কখনো রাতে আবার কখনো দিনে পাহাড় কাটছে।এর ফলে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।পাহাড়ে বসবাসরত বণ্যপ্রাণীরা চলে আসছে লোকালয়ে।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ বেসরকারী ইপিজেড আইনে দেশের প্রথম ব্যক্তি মালিকানায় চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার দেয়াং পাহাড়ে ২ হাজার ৪৯২ একর জমির উপর কোরিয়ান কোম্পানি ইয়াংওয়ান কপোর্রেশন কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) স্থাপন করে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেন। সরকারের সাথে তাদের চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ে সবুজায়নসহ যেখানে যে অবস্থায় আছে সেভাবেই কারখানা নির্মাণ করতে হবে। কোন ভাবেই পাহাড় কাটা যাবেনা।কেইপিজেডকে দেওয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী কেইপিজেড কর্তৃপক্ষকে বাধ্যতামূলকভাবে ৩৩ শতাংশ জমিতে বনায়ন এবং ১৯ শতাংশ জমি জলাধার ও খালি জায়গার জন্য রাখতে বলা হয়েছিল।যার তাদের ফলে কারখানা ও অন্যান্য অবকাঠামোর জন্য জমি থাকবে ১২০০ একরের মতো জায়গা। এ জমির আবার ৩০ শতাংশ ৩৬০ একর জায়গা রাস্তা, পরিসেবা ও আনুষঙ্গিক সহযোগী অবকাঠামোর জন্য ব্যয় হবে। অর্থাৎ কারখানা করা যাবে সব মিলিয়ে ৮৪০ একর জমিতে।কিন্তু আনোয়ারা প্রান্তে যেসকল পাহাড় টিলা ছিলো সেগুলোর ৫০ শতাংশ জায়গায় কারখানা করে বাকি ৫০ শতাংশ জায়গাতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে পুরোদমে পাহাড় এবং টিলাকে সমান করছে কর্তৃপক্ষ।
কয়েক বছর ধরেই চৈত্র মাসে কেইপিজেডের ভেতর বনের বিভিন্ন স্থানে আগুন দেয় বনখেকোরা। কিছুদিন আগেও পাহাড়ের আগুন জ্বলতে দেখা যায়।সেখানে আবার পাহাড় নিধন করে পাহাড় খেকোরা।এ সুযোগে নিরিবিলি পরিবেশ থাকায় বনের মূল্যবান বৃক্ষও পাচার করার অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, দেয়াং পাহাড় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি ঐতিহাসিক পাহাড় এটি চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর বর্তমান আনোয়ারা কর্ণফুলী জুড়ে অবস্থিত। এই অঞ্চলেই আরাকানিদের চাটিগা দুর্গ ও দেয়াত অবস্থিত ছিল। এ পাহাড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। এসব সংরক্ষণ ও দেখার দায়িত্ব বন বিভাগের। কিন্তু বনের বাগানে আগুন দেয় বনখেকোরা।যেখানে অসহায় বন বিভাগসেখানে ফ্লিম স্টাইলে পাহাড় কেটে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ স্থাপন করছেন একের পর এক কারখানা। এতে ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। আর একের পর এক পাহাড় কাটায় বণ্যপ্রাণীরা হারিয়ে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেয়াং পাহাড়ের অপার সৌন্দর্য।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান,আনোয়ারা-কর্ণফুলীর দেয়াং পাহাড়ে গড়ে উঠেছে কেইপিজেড।এখানে একসময় ৪০ হতে ৬০ ফিটেরও অধিক উঁচু পাহাড় ও ৩০ ফিটের উঁচু টিলা ছিল।পরিবেশ অধিদপ্তরকে তাদের তৈরী করা উঁচু রাস্তাগুলোকে সমতল দেখিয়ে পাহাড় কেটে সমতল করে কারখানা গড়ে তুলেছে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ।কেইপিজেডের সমতলের পাহাড়গুলো সবুজ ঘাসে বেষ্টিত।যেখান পাহাড়ে রয়েছে বন্যপ্রাণি।এখন বনের জমিতে থাকা গাছগাছালি আগুনে পুড়ে উজাড় করা হচ্ছে।এতে সংকট দেখা দেয় গো খাদ্যের। হাতির আবাস নষ্ট করার কারণে লোকালয়ে হামা হামলা করছিল হাতির দল।কয়েকদিন আগে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। এসময় মাঠে খেলতে গিয়ে দুই শিশু নিহত ও আরও দুইজন শিশু আহত হয়েছেন।এই বিচরণভূমিগুলো এখন পুড়িয়ে মরুভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে।কেইপিজেড পরিকল্পিতভাবেই এগুলো করছে। এমনটাই দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
সব অভিযোগ উড়িয়ে ভিত্তিহীন
এ বিষয়ে কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো মুশফিকুর রহমান বলেন, আমি প্রথমে আপনাকে একটা বিষয় বলি কেন যেন একটি গ্রুফ অপপ্রচার করছে ডেফিনেটলি। কে ইপিজেড একটি আন্তর্জাতিক মানের একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান। এটা এখানে একটা স্ট্যান্ডার্ড মেন্টেইন করে। সরকার যত গুলো আইন কানুন আছে সবগুলো ডেপ্লই করে। এখানে আমরা অনেক বৃহৎ একটি পরিকল্পনা করেছি। ইপিজেডের কন্টর ঠিক রেখে উন্নয়ন করা হচ্ছে। পাহাড় কাটা কোনো বিষয় না। এখানে বিদেশী মানের হাসপাতাল হবে। নার্সিং কলেজ করেছি। এখন বুঝতেসিনা এটা কি দেশীয় চক্র নাকি বিদেশী চক্র তা জানিনা তারা হয়তো চাচ্ছেনা এই দেশে কোন এমপ্লইমেন্ট না হোক। আবার সো কল্ড কিছু সাংবাদিক বলতেসে এখানে পাহাড় কাটা হচ্ছে। এটা কি সাংবাদিকতা নাকি হলুদ সাংবাদিকতা বলে এখানে পাহাড় কাটতেসে। এইসব কি? তবে যারা এখানে পাহাড় কাটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তা অবাস্তব ও ভিত্তিহীন। এখানে কোনো পাহাড় ছিলো না। যা ছিলো সব টিলা। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি এশিয়াতে বাংলাদেশকে পরিচিত করিয়েছি আমরা। এই ইপিজেডের মাধ্যমে।বাংলাদেশের অন্যান্য ইপিজেড ইপিজেড দেখেন আর আমারটা দেখেন। তখন তফাৎ বুঝবেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক মো. মঈনুদ্দিন ফায়সাল বলেন,ঢাকা থেকে এক্সপার্ট টিম দিয়ে তারা কতটুকু অনুমোদন নিয়েছে মাটি কাটার জন্য তা পরীক্ষা করা হবে৷ আর অনুমোদন অনুযায়ী কতটুকু কাটতে পারবে তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হবে।আপাতত মাটি কাটা বন্ধ রয়েছে।
এসকল বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশবিদ আলিউর রহমান বলেন, কোনো স্থাপনা নির্মানে পাহার টিলা কর্তনের সুযোগ নেই। কে ইপিজেডে যা ঘটেছে তার জন্য ইপিজেডের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। নির্বিচারে পাহাড় কাটা বা তার উপর প্রাণহানীও ঘটেছে। এর জবাব অবশ্যই দিতে হবে।
এছাড়া এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ইচ্ছায় পাশে দাঁড়ানোর কথা ও বলেন তিনি।
এএস/বাংলাধারা