বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের থেকে বিভিন্নখাতে আদায় করা হয় টাকা। তবে সে সব খাতে কাজ না হলেও বিদ্যালয়ের হিসাবে দেখানো হত খরচ। বিদ্যালয়ের ব্যাংক থেকে নিজের ছেলে ও আত্মীয়দের দিয়ে তুলে নিতেন টাকা। প্রধান শিক্ষক থাকাকালে এভাবেই বিদ্যালয়ের টাকা আত্মসাৎ করেছেন চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী রেলওয়ে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক সুনীল চন্দ শীল। গত বছরের জুন মাসে অবসরে গেছেন তিনি।
গত মাসে এক তদন্তে বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। সেখানে প্রধান শিক্ষক থাকাকালে বিদ্যালয়ের বিভিন্নখাতে শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করা টাকা ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাতের তথ্য উঠে আসে। তদন্ত প্রতিবেদনে সুনীল চন্দ শীলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন সহকারী শিক্ষক থাকার পর ২০২২ সালের মে মাসে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি বিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনিয়ম-দূর্নীতি করে আসছেন। তাঁর দূর্নীতির সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা থাকায় এ নিয়ে কেউ মুখ খুলেননি। তবে গত জুলাই মাসে সুনীল চন্দ শীল অবসরে যাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি দেন শিক্ষকদের একটি অংশ।
সবশেষ গত ২৪ নভেম্বর রেলওয়ের প্রধান সংস্থাপন কর্মকর্তা (পূর্ব) বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন রেলওয়ের (পূর্ব) ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টর মোজাফফর আহামদ। প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই বছর চার মাস প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা সুনীল চন্দ্র শীল ছাত্রদের কাছ থেকে বিভিন্ন খাতে তোলা টাকার মধ্যে দেড় কোটি টাকা ভুয়া বিল-ভাউচারে আত্মসাৎ করেছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সুনীল চন্দ্র শীল দায়িত্ব গ্রহনের আগে ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল এক কোটি টাকার মতো। অবসরের যাওয়ার আগ পর্যন্ত মোট লেনদেন হয়েছে এক কোটি ৯২ লাখ টাকা। যার মধ্যে দেড় কোটি টাকার আত্মসাৎ করেছেন তিনি। এ ছাড়া খণ্ডকালীন শিক্ষকদের জন্য আদায় করা ১৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখেছেন।
২১টি খাতে ভুয়া ভাউচার
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর বেতন, নাশতা, মিলাদ, ক্রীড়া, স্কাউট, বিএনসিসি, বিজ্ঞানাগারসহ মোট ২১টি খাত বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শ্রেণিভেদে প্রায় এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা আদায় করা হয়। সুনীল চন্দ্র শীল প্রায় দুই বছর ৪ মাস প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর দায়িত্ব থাকাকালে এসব খাত বাবদ আদায় হয়েছে প্রায় ৮৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা।
বিদ্যালয়ের নথি থেকে জানা গেছে, সুনীলের মেয়াদকালে ২১টি খাতে মোট আদায় হয়েছে ৮৭ লাখ ৬৮ হাজার ৭৯৫ টাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। এর আগে ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল প্রায় এক কোটি তিন লাখ ৪১ হাজার টাকা। তাঁর সময়কালের মধ্যে লেনদেন হয়েছে প্রায় এক কোটি ৯২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। যার মধ্যে দেড় কোটি টাকার হিসাব গড়মিল। তাঁর অবসরে যাওয়ার দিন ব্যাংক হিসাবে ছিল কেবল ১৭ হাজার ৪৬২ টাকা।
সুনীল চন্দ্র শীল যে সব খাতে টাকা তুলেছেন তাঁর মধ্যে নাশতা, ইবাদত খানা নির্মাণ, মাঠ সংস্কার, বিজ্ঞানাগার সংস্কার, গ্রন্থাগারের উন্নয়ন বিভিন্ন খাতে কোটি টাকার উপরে হিসাব দেখিয়েছে। তবে এসবের কিছুই তিনি করেননি বলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। সরেজমিনে ঘুরে, বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানাগার অধিকাংশ সময় তালা দেওয়া দেখা গেছে। ইবাদত খানা বলতে একটি ছোট কক্ষ দেখা গেছে। এ ছাড়া গত তিন বছরের কোনো ম্যাগাজিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, বিদ্যালয়ের মাঠের জন্য প্রতিবছর টাকার খরচ দেখানো হলেও সংস্কার হয়েছে একবার। ম্যাগাজিন বের না হলেও তা বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছে। বিজ্ঞানাগারে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ প্রায় বন্ধ থাকলেও সেটি সংস্কার বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ভাউচারে। এর বাইরে ইবাদত খানা নির্মাণদের জন্য কয়েক লাখ টাকার ভাউচার করা হলেও সেটির অস্তিত্ব জানেন না অধিকাংশ শিক্ষার্থী।
‘ব্যক্তিগত কাজে কিছু টাকা নিয়েছি’
বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ প্রসঙ্গে গত ১৫ ডিসেম্বর প্রধান সংস্থাপন কর্মকর্তা বরাবর চিঠি দিয়েছেন সুনীল চন্দ্র শীল। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, আমি ব্যক্তিগত কাজের জন্য কিছু টাকা নিয়েছি। বিদ্যালয়ে বিভিন্ন খাত অনুযায়ী আমার কাছে ১৬ লাখ ৯১ হাজার ২৫০ টাকা পাবে। সেখান থেকে ৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা বাকী আছে। আমার চূড়ান্ত হিসাব এখনও বাকী আছে। এরপর সে টাকা আমি জমা দিব।
বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবের লেনদেনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের হিসাব থেকে বড় অংকের টাকা উত্তোলন করেছেন শুভ রায় ও রাখাল চন্দ্র নামে দুই ব্যক্তি। শুভ রায় রেলওয়ের সহকারী লোকমাস্টার পদে চাকরিরত। তিনি সুনীল চন্দ্র শীলের ছেলে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সুনীল চন্দ্র শীলের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তবে চিঠিতে তাঁর ছেলে ও আত্মীয় রাখালের মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের জুনিয়র ওয়েলফেয়ার অফিসার ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন সোহেল বলেন, আমরা এ বিষয়টি এখনো তদন্ত করছি। চলমান তদন্ত প্রতিবেদন শীগ্রই জমা দেওয়া হবে।