ksrm-ads

২১ মে ২০২৫

ksrm-ads

মহিউদ্দিন চৌধুরী : যুগ যুগের মানবতাবাদ

আবদুস সবুর লিটন 

তৃণমূল থেকে রাজপথে মরহুম আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী এবং দেশরত্ন শেখ হাসিনার একজন বিশ্বস্ত সৈনিক। তাঁর জীবন আখ্যান কখনও গল্পের বুননে, কখনও উপন্যাসের ঢঙে। যিনি জেল-জুলুম, নির্যাতন ভোগ করে নিপীড়িত মানুষের মাঝেই মিশে যেতেন। আবার কখনো পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্তির জন্য মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার লক্ষে সংগ্রাম করেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।

এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য ছাত্রনেতা। একজন জননেতা, জনতার নেতা, গণ মানুষের নেতা, হাজারো অসহায়ের ভরসারস্থল, লাখো জনতার আরাধ্য পুরুষ, বঞ্চিত-নিপীড়িতের সূহৃদ-স্বজ্জন, দুস্থ-অবহেলিতের আশার বাতিঘর, মুজিবাদর্শের লড়াকু সৈনিক, জননেত্রী শেখ হাসিনার পরম বিশ্বাসের অদম্য সাহসী এক ত্যাগী সিপাহসালার। চট্টলবাসীর সুখে-দুখে, দুর্যোগ-দুঃসময়ে নিবেদিত বন্ধু। বিত্ত-বৈভব, সম্পদের মোহ, অবৈধ উপার্জন, বিলাসী জীবন কিছুই যাকে স্পর্শ করেনি এমন এক মানবিক নেতা, মানবতার ফেরিওয়ালা।

২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষকে কাঁদিয়ে চিরতরে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আজ তাঁর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী।

প্রয়াত এই আওয়ামী লীগ নেতা একেবারে তৃণমূল থেকে উঠে এসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন। ষাটের দশকে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। একাত্তরে গঠন করেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। সেই সময় গ্রেফতার হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। পরে পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে বাধ্য হয়ে চলে যান ভারতে। সেখানে উত্তর প্রদেশের তান্ডুয়া সামরিক ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্কোয়াডের কমান্ডার নিযুক্ত হন। স্বাধীনতার পর যুবলীগের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে প্রতিশোধ নিতে মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন করেন। ওই সময় সামরিক সরকার তাঁকে ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করলে তিনি পালিয়ে কলকাতায় চলে যান।

পাকিস্তান আমলে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাকায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশ শত্রু মুক্ত করার আন্দোলন করায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর দলের অস্তিত্ব ধরে রাখায় বারবার শাসক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছিলেন এই নেতা। তারপরও রাজনীতি ছাড়েননি। আঘাত পেয়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এভাবেই দলমতের ঊর্ধ্বে গিয়ে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন। পেয়েছিলেন ‘চট্টলবীর’ উপাধি। তাইতো দল, মত নির্বিশেষে সবাই প্রয়াত এই নেতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে তার জন্ম। বাবা হোসেন আহমদ চৌধুরী আর মা বেদুরা বেগম। আট ভাইবোনের মাঝে মহিউদ্দিন ছিলেন মেজ। তার বাবা চাকরি করতেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে। বাবার চাকরির সুবাদে মহিউদ্দিন পড়াশুনা করেছেন মাইজদি জেলা স্কুল, নগরীর কাজেম আলী ইংলিশ হাই, আর প্রবর্তক সংঘে। স্কুল জীবনেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। মাধ্যমিকের শেষে বাবার আদেশে ভর্তি হন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে। পরে সেখান থেকে ভর্তি হন সিটি কলেজে। সিটি কলেজ থেকে তিনি স্মাতক পাশ করেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই মহিউদ্দিন চৌধুরী জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসেন।

১৯৬৮ ও ‘৬৯ সালে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মহিউদ্দিন একাত্তরে গঠন করেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমি সদর দফতরের কাছ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে আটক হন। এরপর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় চার মাস। পরে পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন সম্মুখ সমরে। যুদ্ধ করেন ভারত-বাংলা যৌথবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে।

স্বাধীনতার পর শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন।

পঁচাত্তরে জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হওয়ার পর প্রতিশোধ নিতে মৌলভি সৈয়দের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেসময় ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হলে তিনি পালিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরেন।

দেশে আসলে তার ওপর আরোপিত হয় একের পর এক হুলিয়া। শুরু হয় সামরিক বাহিনীর হাতে নিষ্পেষণ, নির্যাতন আর একের পর এক কারাভোগ। জিয়া সরকারের আমলে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন। এসময় তার ভয়ে তটস্থ থাকাতো সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দিতেও তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন।

এরপর এরশাদ সরকারের শাসনামলে স্বয়ং এরশাদকে চট্টগ্রাম অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে সরকারের চক্ষুশূল হন মহিউদ্দিন। এ সময় আবারও রাজনৈতিক বন্দি জীবন কাটে তাঁর। ততদিনে চট্টগ্রামের আপামর জনতার নয়নের মণি হয়ে ওঠেন মহিউদ্দীন চৌধুরী।

পরবর্তীতে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির অন্যতম সুপুরুষ বলে বিবেচিত হন সর্বমহলে। ‘৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে দুস্থ জনতার পাশে দাঁড়িয়ে, অসহযোগ আন্দোলনে খালেদার সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, গরিব-দুঃখী-শ্রমিকের অধিকারের কথা বলে মহীরুহে পরিণত হন।

চট্টগ্রামে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রায় দুই যুগ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকার পর ২০০৬ সালের ২৭ জুন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু তিনি এই পদে ছিলেন।
আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী নিষ্পেষিত মানুষের সুখ-দুঃখের কথায় মনোনিবেশ করতেন গভীর নিমগ্নতায়। দুঃখী মানুষের সমস্যা ঘোচাতে ব্যাকুল থাকতেন নিজের শেষ সামর্থ্যটুকু দিয়ে। তাঁর জীবদ্দশায় বহুবার পবিত্র হজ্ব পালন করেছেন। তাঁর রেখে যাওয়া কর্মে ও লাখো মানুষের মনে বেঁচে থাকলেও আজ তিনি পৃথিবীর বুকে বেঁচে নেই। মরহুমের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : প্যানেল মেয়র-১, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও কাউন্সিলর ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ড

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ