সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
পরে অনুমোদন পেয়েও একাধিক কলেজের হাসপাতাল নির্মাণ শেষ হয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজের (কমেক) হাসপাতাল আলোরমুখ না দেখা দুঃখজনক উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি বলেছেন, ভুল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) কারণে কমেকের হাসপাতাল নির্মাণটি অর্ধযুগ ধরে পিছিয়ে রয়েছে। বৈদেশিক সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তটিই এ হাসপাতাল প্রকল্প পেছানর মূলকারণ। তবে, মানসম্মত চিকিৎসক তৈরীতে একটি মেডিক্যালে পরিপূর্ণ হাসপাতাল অপরিহার্য।
কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ (কমেক) পরিদর্শন শেষে সোমবার (৩ অক্টোবর) দুপুরে মতবিনিময় সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেছেন।
সভায় কমেক শিক্ষক ডা. শাখাওয়াত হোসেন ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের পক্ষে তাজমীর বলেন, কমেক পর্যটন নগরীতে প্রধানমন্ত্রীর অবদান। যা পেয়ে এতদঞ্চলের মানুষ কৃতজ্ঞ। ২০০৮ সালে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে যাত্রা, ২০১৬ সালে স্থায়ী ক্যাম্পাস মিলেছে। মানসম্মত অধ্যয়নে দেশ সেরা ফলাফল করছে কমেক শিক্ষার্থীরা। সবকিছু ঠিক থাকলেও ৫০০ শয্যার হাসপাতাল না থাকায় ইন্টার্ন চিকিৎসকরা চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে। আবাসন সমস্যা প্রখট। চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছে স্থানীয়রা। শুরুতে ৫৮ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও চলমান সময়ে ৭০ জন শিক্ষার্থী প্রতিবছর ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। পুরোনো শিক্ষার্থী মিলিয়ে সবার আবাসন সংকুলান হচ্ছে না হোস্টেলে। সবকিছু ছাপিয়ে ক্যাম্পাসটি এখন অনিরাপদই বলা যায়। কলেজের লাগোয়া হাসপাতাল না থাকায়, অস্থায়ী ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালন শেষে ক্লাসে ফেরা কষ্টকর।
জবাবে মন্ত্রী বলেন, প্রতিমন্ত্রী থাকতে কমেকে এসেছিলাম। তখন দেখেছি, অগোছালো অবস্থা। এলওসিতে প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্র হাসপাতালটি করে দেয়ার কথাছিলো। কিন্তু অনাকাঙ্খিত কিছু কারণে সেই প্রকল্প ভেস্তে যায়। একারণে দুঃখজনক ভাবে হাসপাতাল নির্মাণ পিছিয়েছে। তবে, আমরা বসে নেই- কক্সবাজারসহ আরো চারটি হাসপাতাল জিও ফান্ডে সম্পন্ন করতে ডিপিপি ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাশ হয়েছে। একনেকে পাশ হলেই, শিগগিরই হাসপাতাল নির্মাণ কাজে হাত দেয়া হবে।
মন্ত্রী আরও বলেন, দেশে ৪৮টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ চলমান। বছরে ১১ হাজার শিক্ষার্থী চিকিৎসা বিদ্যায় ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। বেসরকারি ৭২টি মিলিয়ে বিদ্যমান ১১০টি মেডিকেল কলেজকে মানসম্মত চিকিৎসক তৈরির নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে চাই। ইউরোপ-আমেরিকায় অনেক ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার টেক্সী চালিয়ে জীবন চালায়। মানসম্মত চিকিৎসক হয়ে উঠতে না পারায় হয়তো এমনটি ঘটছে। কিন্তু মানবের পৃথিবীতে আসা-যাওয়ায় একজন চিকিৎসকের হাতেই হয়। চিকিৎসার মতো সেবা নিশ্চিত করার পেশা পৃথিবীতে আর নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতেই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পুনঃ মেরামত করা হচ্ছে। মেডিকেল কলেজে প্রাজ্ঞ শিক্ষক দিতে না পারলে- মানসম্মত শিক্ষা অসম্ভব। কক্সবাজার এলাকার যেসব সন্তান বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন, তারা কক্সবাজার কলেজে আসার আগ্রহ দেখালে যেকোন মুহূর্তে পদায়ন করা হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, খালি পদে লোকবল পদায়ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যারা পদোন্নতি পাবার তারা দ্রুতই পাবেন। কমেকে হাসপাতাল এতদিন না হওয়ার দায় আমাদের। বিদেশি ফান্ডের নির্ভরতায় আমরা ভোগেছি। আশা করছি তা অতিসহসা সমাধান হবে। শুরুতে ৫৮ জনের থাকার ব্যবস্তা করা হয়েছিল, এখন শিক্ষার্থী বাড়ায় আবাসন সমস্যা সমাধানেও কাজ চলছে।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে অস্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের মাধ্যমে কমেকের যাত্রা শুরু হয়। পরে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রূপ দিতে কক্সবাজার সদরের জানারঘোনায় ৩৩ একর জমি অধিগ্রহণ হয়। সীমানা প্রাচীর দিয়ে গড়া হয় মনোরম ক্যাম্পাস। ১০ তলা বিশিষ্ট একাডেমিক ভবন, ২টি ছাত্রাবাস ও খেলার মাঠসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে নিজস্ব ক্যাম্পাসে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। তবে অনুমোদন পাওয়া ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটি এখনও গড়ে না ওঠায় জেলা সদর হাসপাতালে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হচ্ছে কমেক শিক্ষার্থীদের।
কমেক অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফরহাদ হোসেন বলেন, মেডিক্যাল কলেজের সাথে হাসপাতাল খুবই প্রয়োজন। এখনও কমেকের নিজস্ব হাসপাতাল না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ক্লিনিক্যাল ক্লাস করতে প্রতিদিন সকাল-বিকাল অস্থায়ী ক্যাম্পাস কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গিয়ে ক্লাস করতে হয় বলে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
অধ্যক্ষ আরও বলেন, কমেকসহ দেশের চার মেডিক্যাল কলেজের জন্য আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাসও হয়। ওই প্রকল্পে কমেক’র হাসপাতাল ভবনসহ অবকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ ধরা হয় ৬০০ কোটি টাকা। প্রকল্পে ছিলো, ১০ তলা বিশিষ্ট হাসপাতাল ভবন (প্রতি ফ্লোরে স্পেস হবে ১ লাখ ৩০ হাজার স্কয়ার ফিট), ডক্টরস কোয়ার্টার, নার্সেস কোয়ার্টার, অডিটরিয়াম, কনফারেন্স রুম, আলাদা সড়ক, ছাত্রছাত্রী বাড়লে হোস্টেল নির্মাণ ইত্যাদি। কিন্তু একনেকে পাস হবার পর থেকে দেশের বাকি তিনটি মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালসহ অবকাঠামো নির্মাণ হলেও কক্সবাজার মেডিকেল হাসপাতাল নির্মাণ কার্যক্রম থমকে যায়। এরপরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হয়। এরই অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ অন্য উর্ধতনরা আজ (৩ অক্টোবর) কমেকে এসেছেন।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ) কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, কক্সবাজারে সবচেয়ে একটা বড় ইস্যু রোহিঙ্গা সমস্যা। ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় অনেক কার্যক্রম হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা বঞ্চিত হচ্ছে সিকিৎসা সেবায়। এরই অংশ হিসেবে স্থানীয়দের স্বাস্থ্যসেবায় প্রায় ১২০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম হবে। যেটাতে অর্থ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণে লাগবে ২০০ কোটি টাকা। কক্সবাজার সদর হাসপাতাল এলাকায় ইচ্ছে করলেও অবকাঠামোর উন্নয়নের সুযোগ নেই। সে হিসেবে কমেকে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ হলে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের সেবা বাড়বে। চিকিৎসা জট কমবে সদর হাসপাতালে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত যাতায়াত সমস্যাও লাগব হবে।
কমেক সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমেক। একলেজে এক বছর মেয়াদি হাতে-কলমে শিখনসহ (ইন্টার্নশিপ) স্নাতক পর্যায়ের পাঁচ বছর মেয়াদি ‘এমবিবিএস’ শিক্ষাক্রম চালু রয়েছে; যাতে প্রতি বছর ৭০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। বর্তমানে এ মেডিকেলে ৩৪৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। কোভিট-১৯ শুরুর পর ১ এপ্রিল ২০২০ হতে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪৫ জন আর.টি.পি.সি.আর পরীক্ষার আওতায় এসেছে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ পিসিআর ল্যাবে।