মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »
প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী প্র্রায় ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অন্যতম কার্প জাতীয় মাছের (রুই, কাতল, মৃগেল, কালিবাউশ) প্রজনন কেন্দ্র। হালদা থেকে এক যুগের ইতিহাসে ২০২০ সালেই ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি মাছের ডিম সংগ্রহ হয়েছে, যা ২০১৯ সালের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি। ২০২১ সালেও এমন টার্গেট পূরণ হয়নি।
প্রায় ৩শ’ নৌকায় সাড়ে ৬শ’ জন মিলে এই ডিম সংগ্রহ করেছেন। গত ১২ বছরে সবচেয়ে বেশি ডিম পাওয়া গেছে ২০২০ সালেই। মাঠ প্রশাসন, গবেষক এবং স্থানীয় সচেতন নাগরিক মহলের সমন্বিত কার্যক্রমেই হালদা নদী থেকে ডিম আহরণে এ বছরের রেকর্ড অর্জিত হয়েছে। হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিনের তত্ত্বাবধানেই তা সম্ভব হয়েছে বলে পোণাজীবিরা স্বীকার করেছে।
হালদা নদী এবং নদীর পানির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানে মাছ ডিম ছাড়তে আসে বর্ষা মৌসুমের আগেই। টানা দুই তিন দিনের বৃষ্টিতেই মা মাছেরা মুখ থেকে ডিম ছেড়ে দেয়। নদীর এমন ইতিহাস শুধু এদেশেই নয় দক্ষিণ এশিয়া এমনকি বিশ্বেও নেই।

এ বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক কারনেই হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। হালদার দুই পাড়ের মানুষ মিঠা পানির মাছের প্রাকৃতিক এই প্রজনন ক্ষেত্র থেকে প্রতি বছর বর্ষার শুরুতেই উৎসব মুখর পরিবেশে মা মাছের মুখ থেকে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করে। ডিম আহরণের এই রেওয়াজ যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় চলে আসছে হালদা পাড়ের মানুষের।
হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় হাটহাজারি উপজেলা প্রশাসন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। হালদায় প্রজনন বাড়াতে হাটহাজারীর সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) মোহাম্মদ রুহুল আমীন প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জিং কার্যক্রম সফলভাবে মোকাবেলা করছেন। এরই ফলশ্রুতিতে হালদা নদী এখন সংরক্ষিত জোনে পরিণত হয়েছে।
২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেল লাইনে ফার্নেস তেলবাহী কয়েকটি অয়েল ট্যাংকার বাহী ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। হালদার যোগসূত্র মরাছরা খালের রেল সেতুটি ভেঙ্গে একটি অয়েল ট্যাংকার সম্পূর্ণভাবে পানিতে পতিত হয়। পতিত ট্যাংকারে ছিল ২৫ হাজার লিটার ফার্ণেস তেল যার সিংহভাগই ছড়িয়ে পড়ে পানিতে। এ সময় ফার্নেস তেল মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ে মিঠা পানির মাছের প্রাকৃতিক ব্যাংক খ্যাত হালদা নদীতে। তখন ইউএনও রুহুল আমিনের উদ্যোগেই আড়াই কিলোমিটার খালের মধ্যে ১২টি বাঁধ নির্মাণ করা হয় তড়িৎ গতিতে। তখন টানা পাঁচ দিন কাজ করে হালদা থেকে প্রায় শতভাগ তেল অপসারণ করে নেয় শ্রমিকরা। ফলে হালদা নদী ভয়াবহ দূষণ থেকে রক্ষা পায়।

এছাড়াও হালদা নদী থেকেই বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরে বসবাসকারী ৮০ লাখ লোককে পানি সরবরাহ করে। ২০১৮ সালের আগে এলাকার ময়লা আবর্জনায় হালদা নদীর ক্রিয়দাংশ ভাগাড়ে পরিণত হতো। হাটহাজারী পৌর এলাকার প্রধান খাল ‘কামাল পাড়া’ খালের মুখে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে লোহার গ্রীল বসানো হয়। ইউএনও এর তত্বাবধানে আটকে যাওয়া ময়লা আবর্জনা প্রতি সপ্তাহে পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয়ার ফলে হাটহাজারী পৌর এলাকার বিভিন্ন নালা-নর্দমা থেকে আসা ময়লা-আবর্জনা এখন আর পড়ছে না হালদা নদীতে।
হালদা টিকিয়ে রাখতে হলে কল-কারখানার দূষণ ঠেকাতে হবে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য হালদায় ফেলা বন্ধ করতে হবে, মানিকছড়ির পাহাড়ে তামাকচাষ বন্ধ করা গেলে দূষণ অনেকাংশে কমে যাবে। বছরব্যাপী হালদায় মাছের চোরা শিকারি ও বালু উত্তোলনকারীদের তৎপরতা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারলে হালদার প্রজনন বাড়ানো সম্ভব।
পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক এশিয়ান পেপার মিল ও ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ করার পর থেকে প্রজনন আরো বেড়েছে।এর আগে হালদা নদীতে দুষিত কেমিক্যাল ফেলার কারনে প্রজনন অনেকটা কমেই গিয়েছিল।
হালদা অভিযানের বিভিন্ন্ তথ্য থেকে জানা গেছে ২০২০ সালে ১০৯ বার হালদা নদীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এসব অভিযানে ২ লাখ ২১ হাজার মিটার ঘেরজাল জব্দ করা হয়েছে, যেগুলো দিয়ে মা মাছ শিকার করা হতো। বালু উত্তোলনকারী ৯টি ড্রেজার ও ১৫টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ধ্বংস করা হয়েছে। সাড়ে তিন কিলোমিটারেরও বেশি বালু উত্তোলনে ব্যবহƒত পাইপ ধ্বংস করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ঘনফুট বালু।

উপজেলা প্রশাসনের তথ্য থেকে প্রকাশ পেয়েছে, চট্টগ্রাম জেলার বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেনের নির্দেশনায় ২০১৯ সালের শুরু থেকেই হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় হ্যাচারিগুলোতে ডিম পরিস্ফুটনের কাজ অত্যন্ত সুন্দর ও শৃঙ্খলার সাথে সম্পন্ন হয়েছে। হাটহাজারী উপজেলার ডিম পরিস্ফুটনের জন্য নির্মিত তিনটি হ্যাচারির প্রায় ৭০ ভাগ কুয়া বা আয়তকার চৌবাচ্চা গত ৫ বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল। ২০১৯ সালে ডিম ছাড়ার প্রায় দুই মাস পূর্বে শতভাগ কুয়া ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলে উপজেলা প্রশাসন।
শুধু তাই নয়, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয় এসব চৌবাচ্চায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে কাজের তত্ত্বাবধান করা হয়। নিয়োগ দেয়া হয় কেয়ারটেকার, সার্বক্ষনিক গ্রাম পুলিশ মোতায়েন করে ডিম সংগ্রহকারীদের দেয়া হয় আস্থার পরিবেশ। ১৪১ টি মাটির তৈরি কুয়া এবং সরকারি ৫ হ্যাচারির ১৩১ টি কুয়ায় ডিম পরিস্ফুটন করা হয়।
২০১৮ সালের বিবেচনায় ২০১৯ সালে রেণু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১১৭ কেজি। কিন্তু যথাযথ হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা ও সংস্কারের কারণে গত বছর ২০১৯ সালে প্রায় ২০০ কেজি রেণু উৎপাদিত হয়। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় ৮০ কেজি বেশি ছিল।

হালদার অতীত ও বর্তমান বিশ্লেষণে জানা গেছে, ২০১৯ সালে প্রায় সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে স্থানীয়রা ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। এর আগে ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদা নদী থেকে শুধুমাত্র রুই বা কার্প জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল এবং কালিবাউশ) মাছের ডিম সংগ্রহ, রেণু উৎপাদন, পোনা বিক্রি ও মাছ বিক্রি করে বছরে উপজেলা প্রশাসনের আয় হয় প্রায় প্রায় ৮২১ কোটি টাকা। যা ওই সময়ের দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৬ শতাংশ।
নদী হিসেবে এককভাবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্যক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে হালদা নদী। আর এই নদীর বালি উত্তোলন, চট্টগ্রাম ওয়াসার খাবার পানি সংগ্রহ, নদীর উভয় পাড়ের মানুষের কৃষিকার্য, জীবন-জীবিকা প্রভৃতি মিলিয়ে বছরে প্রায় ১০ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা আয় হয় এই নদীকে ঘিরে। এছাড়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এবং পরিবেশগত মূল্যে হয়তো আরও বাড়তে পারে।
হালদার উৎপত্তি প্রসঙ্গে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি পার্বত্যজেলার মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের একটি পাহাড়ী গ্রামের নাম সালদা। এই গ্রামের ঝর্ণা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকেই হালদা নামকরণ হয়। হালদা ছরা মানিকছড়ি উপজেলার মানিকছড়ি খালের সাথে মিলিত হয়ে প্রথমে হালদা খাল এবং পরবর্তীতে ফটিকছড়ির ধুরং খালের সাথে মিলিত হয়ে হালদা নদীতে পরিণত হয়েছে। এই নদী চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি, রাউজান এবং হাটহাজারী উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রাম মহানগরের চাঁন্দগাঁও থানার কালুরঘাট নামক স্থানে কর্ণফুলী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এটিই বিশ্বের একমাত্র জোয়ার ভাটার নদী।
বাংলাধারা/এফএস/এফএস