নাবিক ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মায়ের চোখে আনন্দ অশ্রু, ফিরে আসার উচ্ছ্বাস মা-ছেলের চোখে-মুখে, শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে চুমুতে চুমুতে আনন্দের কান্না, বাবাকে পেয়ে দুই গালে দুই মেয়ের চুমুতে চুমুতে ভালোবাসার প্রকাশের এমন স্বর্গীয় দৃশ্য আমাদের হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়, আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের কোণায় জল করে টলমল।
দেশে ফিরেই নাবিক আইনুল হক বললেন, ‘মনে হচ্ছে আমার নতুন জন্ম হয়েছে’। পৃথিবীতে বাবারা সন্তানের জন্মের পর মুখ দেখে যেমন উচ্ছ্বসিত, উল্লাসিত হন- আজ সেই বাবার নতুন জন্মের কথা শুনে আনন্দের কান্নায় ভেঙে পড়েছে সন্তানরা। মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের জেটি চত্বর ছিল এমনই আনন্দ আর আবেগঘন পরিবেশ।
মঙ্গলবার বিকেলে একটি ছোট জাহাজে করে তারা পৌঁছাবেন চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি-১) জেটিতে। সেখানেই দুই মাস পর সামনা সামনি দেখা হবে পরিবারের সদস্যদের সাথে।
সাধারণত নাবিকরা ছয় মাস বা আরো বেশি সময়ের জন্য জাহাজে করে দেশ ছেড়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যান। জাহাজ ভেড়ে বিশ্বের নানা বন্দরে। তাই দীর্ঘ সময় প্রিয়জনদের অনুপস্থিতিতে খানিকটা অভ্যস্ত নাবিকদের স্বজনরা। কিন্তু এবারের ফেরা অন্য রকম। দুই মাস আগে ভারত মহাসাগরের সোমালিয়া উপকূলে সশস্ত্র সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে আবদুল্লাহ, নাবিকরা হন জিম্মি। পরিবারের সদস্যদের ফোন করে তারা জানান, মুক্তিপণ না দিলে তাদের একে একে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সেই ১২ মার্চ থেকেই পরিবারের সদস্যদের ফিরে পেতে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ আর অনিশ্চিত অপেক্ষার অবসান হবে আজ।
মা অপেক্ষায় আছেন প্রাণপ্রিয় সন্তানের জন্য, প্রিয়তমা স্ত্রী তার স্বামীর জন্য, ভাইয়ের অপেক্ষা ভাইয়ের জন্য আর বাবাকে বরণ করে নিতে সন্তানদের হাতে জাতীয় পতাকা ও মুখে ছিল সূর্যমুখী হাসি। মঙ্গলবারের এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের প্রত্যেকের পরিবারের শেষ কয়েক ঘণ্টা ছিল এমন আনন্দময় অপেক্ষা। নাবিক স্বজনরা এই অপেক্ষার গ্রহর গুনতে গুনতে শুনালেন অল্প স্বল্প গল্প ও স্মৃতি কথা।
‘ছেলের পছন্দের সব খাবার রান্না করেছি’
ছেলে ফিরে আসার খবরে উচ্ছ্বাস নিয়ে ঘণ্টার পর অপেক্ষা করছেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমদের মা জোছনা বেগম। তাঁর ভাষ্য, ছেলের জন্য অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত যেন অনেক দেরি হচ্ছে। আজ খুব আনন্দ লাগছে। যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আজ আমার ঈদের আনন্দ, যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।
‘সোমালিয়ায় জলদস্যুর কবলে পড়েছিল তখন আতঙ্কে ছিলাম। কষ্টে ছিলাম। কখন কী খবর আসে। এখন ঈদের চেয়ে বেশি আনন্দ। অপেক্ষা করছি কখন ছেলের মা ডাক শুনব। প্রথম দিন যখন জলদস্যুর কবলে পড়ার খবরে দেখলাম যখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল। ঈদটা গেছে মৃত্যুপুরিতে।’- বলেন জোছনা বেগম।
ছেলের ফিরে আসার আনন্দে মা জোছনা বেগম ছেলের পছন্দের খাবার রান্নার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আজ ছেলের পছন্দের সব খাবার রান্না করেছি। এর মধ্যে আছে গরুর মাংস, মুরগি, কই মাছ, শিমের বিচি।’
বন্দরে নেমেই অভ্যর্থনার জটলা ডিঙিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেন তানভীর। তখন মা-ছেলে দুজনই আনন্দে বারবার চোখ মোছেন। তানভীর বলেন, ‘মাকে কিংবা নিজের দেশকে আবার ফিরে পাবো, তা নিয়ে শঙ্কা ছিল। এখন মুক্ত হয়ে মায়ের কাছে ফিরতে পারার আনন্দটাই আলাদা।’
‘পরিবারের সবাই এ দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম’
ঘণ্টার ঘণ্টা চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থান করছিলেন এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা আতিকুল্লাহ খানের ছোট ভাই আবদুর নূর খান আসিফ। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সবাই এ দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। এ দিনটি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। জাহাজসহ অন্য নাবিকদের সঙ্গে আমার ভাই জিম্মি হয়েছেন শুনেই পরিবারের সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। আল্লাহ আমাদের সহায় হয়েছেন।’
জেটিতে ভিড়ছিল জাহাজ, তখন দূর থেকে বাবাকে দেখেই হাতে থাকা জাতীয় পতাকা নাড়িয়ে বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল আতিক উল্লাহ খানের মেজো মেয়ে ছোট্ট উনাইজা। সে বললো, ‘বাবা ফিরে আসায় আমি খুবই খুশি হয়েছি।’
‘বাবার চিন্তায় ঘুমাতে পারিনি’
দীর্ঘ দুই মাস পর বাবাকে কাছে পেয়ে আতিক উল্লাহ খানের বড় মেয়ে ইয়াশরা বলে, ‘বাবার জন্য পুরো ঘর খালি ছিল। ঈদটাও ভালোভাবে কাটাতে পারিনি। ঘুমাতে পারিনি। কখন বাবা আসবে, বাবাকে দেখতে পাব; মায়ের কাছে সবসময় এসবই জিজ্ঞেস করতাম। আজ ঠিকই বাবার কাছে, বাবার পাশে। সামনে পরীক্ষা আছে, সেগুলো শেষ করে বাবাকে নিয়ে বেড়াবো আর ঘুরবো।’
‘এ ঈদে মেহেদি দিই নাই, গতরাতে দিয়েছি’
জাহাজ থেকে নেমেই নিজের অনুভূতির কথা শেয়ার করলেন আতিকুল্লাহ খান। তিনি বলেন, ‘বন্দিদশার দিনগুলো খুবই বীভৎস ছিল। সেই বীভৎস দিন থেকে আলোর দিনে ফিরেছি। সেই দুঃসহ সময়গুলোর কথা মনে করতে চাই না। ট্রমা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। দুই সন্তানকে কাছে পেলাম। বাসায় আরেক সন্তান কান্না করছে। তার কাছে ফিরতে হবে দ্রুত।’
জান্নাতুলের স্বামী এমভি আবদুল্লাহর জেনারেল স্টুয়ার্ড মোহাম্মদ নুর উদ্দিন। বড় এক ঝঞ্ঝাট সামলিয়ে ফিরেছে স্বামী, তাই তাড়াহুড়া করে আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে বন্দরে স্বামীকে নিতে এসেছেন জান্নাতুল। তিনি বলেন, ‘ঈদে মেহেদি দিই নাই। গতকাল রাতে দিয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে গতকাল ছিল চাঁদরাত। আর আজকে আমাদের ঈদের দিন।’
‘গতকাল (সোমবার) রাতেই তাঁর পছন্দের সব খাবার রান্না করেছি। এরপর সবকাজ শেষ করে হাতে মেহেদি রাঙিয়েছি। আমরা তো কোনো বিশেষ আয়োজনে হাতে মেহেদি দিই। ওনি আসছেন- এটা এখন অনেক বড় একটা কারণ, আমার জন্য বিশেষ কিছু। এ মেহেদি ওনার জন্যই দেওয়া।’— বলেন জান্নাতুল।
‘বলতে গেলে এতদিন ঘুমই হয়নি’
প্রিয়জনকে দেখার আগমূহূর্তের অনুভূতির কথা জানিয়ে জেনারেল স্টুয়ার্ড নুর উদ্দিন বলেন, ‘প্রিয়জনকে দেখার অনুভূতি সবসময় আলাদা। এটা প্রকাশ করার মতো নয়। তিনিসহ বাকিরা দেশে প্রবেশ করেছে, জলসীমার মধ্যে এসেছে; এ খবর পাওয়ায় ছিল আমাদের সবার জন্য আনন্দের। এটা মনকে হালকা করেছে, আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা বলে কখনো ভেতরের অনুভূতি প্রকাশ করা যাবে না। তবে ওনাকে কাছ থেকে না দেখা পর্যন্ত টেনশনের শেষ ছিল না। বলতে গেলে এতদিন ঘুমই হয়নি।’
‘আজ দেখা হবে, তাই গতকাল রাতে একটুও ঘুম হয়নি। কাজ শেষ করে দুইটার দিকে ঘুমালেও চারটায় ভেঙে যায়। প্রিয়জনকে দেখবো, প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা করা; এগুলো এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করে।’
বিয়ের পর জাহাজে গিয়েই জলদস্যুদের কবলে আলী হোসেন
জিম্মি হওয়া জাহাজটির নাবিক আলী হোসেনকে বন্দরে বরণ করতে আসেন তার শ্বশুর জামাল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘মাত্র কিছুদিন আগে আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর জাহাজে গিয়েই জলদস্যুদের কবলে পড়ে আলী হোসেন। এতে সবার মতো আমার মেয়েও পাগলপ্রায়। এখন মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেছে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কিছু হতে পারে না।’
‘সন্তান দুনিয়াতে আসবে, দেখতে পাব— জানতাম না’
শফিকুল ইসলামের জন্য আজকের দিনটি খুবই আনন্দের। কারণ, সোমালিয়ার দস্যুরা এমভি আবদুল্লাহ যখন ছিনতাই করেছিল, তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন নাবিক শফিকুল ইসলামের স্ত্রী সাজিয়া আলম। অতপর শফিকুল-সাজিয়ার ঘর আলো করে আসে কন্যাসন্তান। কন্যাসন্তানের নাম রাখা হয় রাফিয়া ইসলাম রাফা। মঙ্গলবার বাসায় ফিরে শফিকুল ইসলাম আদরের কন্যাকে কোলে তুলে নেন।
‘জিম্মি ছিলাম। সন্তান দুনিয়াতে আসবে, দেখতে পাব কি না, জানতাম না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। সবাই দোয়া করেছেন। আজকে খুশির কোনো সীমা নেই।’— এমন আবেগঘন কথাগুলো এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চিফ কুক শফিকুল ইসলামের।
উল্লেথ্য, গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে কেএসআরএম গ্রুপের এই জাহাজ ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। মুক্তিপণ দিয়ে ৩৩ দিনের মাথায় ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে জাহাজটি মুক্ত হয়। এরপর জাহাজটি প্রথমে আমিরাতের আল-হামরিয়া বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পণ্য খালাস শেষে আরেকটি বন্দর থেকে চুনাপাথর বোঝাই করে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছিল জাহাজটি। গতকাল সোমবার জাহাজটি কুতুবদিয়ায় নোঙর করে। সেখান থেকে এমভি জাহান মণি–৩ জাহাজে করে নাবিকদের বন্দর জেটিতে আনা হয়। এরপর আনুষ্ঠানিকতা সেরে নাবিকেরা বাসায় ফেরেন।