কক্সবাজার প্রতিনিধি »
নয় দফা সুপারিশে ‘কক্সবাজার ঘোষনা’র মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে ‘বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব সংলাপ’। তথ্য প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, জ্বলানী খাত, আঞ্চলিক নিরাপত্তাসহ সম্ভাবনাময়ী বিভিন্ন খাতের সার্বিক উন্নয়ন বিষয়ে এক সাথে কাজ করা জরুরী বলে ঐকমত্য হয়েছেন দু’দেশের অংশগ্রহণকারিরা।
সমাপনী সেশনের প্রধান অতিথি পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে শুধু আশ্রয় নয়, জীবন ধারণের সকল উপকরণ সরবরাহ করে পৃথিবীতে নজির সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। একারণেই শেখ হাসিনা ‘মাদার অব হিউমেনিটি’ উপাধি পেয়েছেন। তাদেরকে দীর্ঘদিন রাখা আমাদের জন্য ভোগান্তির। বন্ধু প্রতীম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে। এটি তড়িত করতে ভারতসহ বন্ধু প্রতীম অন্য দেশ গুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদের চাপ প্রয়োগে এটিই উপযুক্ত সময়।
‘বাংলাদেশ-ভারত কৌশলগত অবস্থান’ বিষয়ে দুদিন ব্যাপী ‘বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব সংলাপ’র সমাপণীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আরো বলেন, এক সময় বাংলাদেশকে ‘তলা বিহীন ঝুঁড়ি’ হিসেবে উল্লেখ করতেন। কিন্তু আজ বিশ্বে উন্নয়নের রুল মডেল হিসেবে আলোচিত হয়। সন্ত্রাসবাদের স্থান বাংলাদেশে নেই। শেখ হাসিনা সরকার জিরো-টলারেন্স নীতিতে এটি দমন করছি।
মন্ত্রী বলেন, ভৌগলিক ভাবেই বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং ঐতিহ্যময়। এ সম্পর্কের সূত্র ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে নরেদ্র মোদী সরকারও আমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েই পাশে রয়েছে। আমরা ভারতের এই ত্যাগের কথা কোন দিন ভুলবো না।
পরারাষ্ট্র মন্ত্রী আরো বলেন, গভীর বন্ধুত্বের কারণে ভারত আমাদের প্রযুক্তি, বিদ্যুত, জ্বালানিসহ সবদিক দিয়েই সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। উন্নয়নে আমরা সহযোগি হিসেবে পাচ্ছি নেপাল-ভুটানসহ প্রতিবেশী অন্যদেশগুলোকেও। দু’দেশের বিরাজমান সমস্যা গুলো সুনির্দিষ্ট করে তা নিরসন ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈনিক অগ্রগতি ধরে রাখতে বন্ধুত্ব সংলাপ সেতুর ন্যায় ভূমিকা রাখছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘গুড গভর্নেস’ তৈরিতে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে তাঁর সরকার অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। যা বিশ্বব্যাপি প্রসংশা পেয়েছে।
পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি লে. কর্ণেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, এমপির সভাপতিত্বে সমাপণীতে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে টেকনো ইন্টারন্যাশরাল কলেজ অব টেকনোলজির পরিচালক ড. রাধা তমাল গোস্বামী বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের উন্নত সম্পর্কের বহি:প্রকাশ সম্প্রতি ত্রিপুরায় গ্যাস সরবরাহ ও মংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকারের জিরু টলারেন্স নীতিতে ভারত সরকার খুবই খুশি। তথ্য প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, জ্বলানী খাত, আঞ্চলিক অর্থনীতি ও নিরাপত্তাসহ সব দিকের উন্ন্য়নে আমরা এক সাথে কাজ করবো।
দ্বিতীয় দিনে (২নভেম্বর) চলা শক্তিশালী আঞ্চলিক নিরপত্তা সেশনে বক্তারা বলেছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অনেক সময় সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি করে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদারে ধর্মকে পূজি করে কার্যক্রম চালানো দলগুলোর কার্যক্রম কঠোর নজরে রাখা দরকার। ভারত-বাংলাদেশের নিরাপত্তা সহযোগিতা উচ্চতায় রয়েছে দাবি করে বক্তারা আরো বলেন, তরুণদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার সম্ভব। বর্তমান সময় প্রযুক্তির। সন্ত্রাস ছড়াতে প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। তাই প্রযুক্তিকে অপব্যবহার রোধে একসাথে কাজ করতে হবে। শেখ হাসিনা সরকার এ বিষয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে, এবং অপরাধ দমনে সফলতাও পাচ্ছে।
উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় দেয়া ১২ রোহিঙ্গার বিষয়ে বক্তারা বলেন, প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হলে আশ্রিত রোহিঙ্গারা আঞ্চলিক সন্ত্রাসের বিস্ফোরক হয়ে দাঁড়াতে পারে। এটি এ অঞ্চলের কোন দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।
প্রতিবেশগত টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক সেশনে বক্তারা বলেছেন, বিশ্ব পর্যটনের প্রসারতা বেড়েছে। এরই মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করা সম্ভব। দেশের সমুদ্র-পাহাড় সম্পদের ব্যবহারে যতœবান হওয়া দরকার। পরিবেশের ক্ষতি না করে প্রতিবেশগত টেকসই উন্নয়নে বেøা-ইকোনোমীর পথে হাটতে দু’বন্ধু প্রতীম দেশকে একিভূত হয়ে কাজ করতে হবে।
টেকনোলজী, পাওয়ার এন্ড এনার্জি সেশনে বাংলাদেশে দায়িত্বপালনকরা ভারতীয় সাবেক হাই কমিশনার ভীনা শিকরি বলেন, প্রযুক্তিতে দ্রæত এগুচ্ছে বাংলাদেশ। বিদ্যুত ও জ্বালানী খাতে ক্রমান্বয়ে যুক্ত হচ্ছে সফলতা। বলতে গেলে সব সেক্টরে সফলতার গল্প তৈরী করেছেন শেখ হাসিনা।
নেপাল থেকে জলবিদ্যুত আমদানির প্রচেষ্টার পাশাপাশি সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাকে ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের উদ্যোগ চলছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশনের সদস্য আবদুল আজিজ খান।
ভারতের রাজ্যসভার বিধায়ক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক এম জে আকবর বলেন, চলমান সময়ে দু’দেশের সম্পর্ক বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ, যা গত ২৫ বছরের চেয়ে ভিন্ন। বাংলাদেশ সব দিক দিয়ে দ্রæত এগুচ্ছে। প্রতিবেশী হিসেবে দু’দেশের সম্পর্ক আরো বন্ধুত্বপূর্ণ রাখা দরকার। দু’দেশের উপর দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলোর যতœ নিয়ে দু’দেশের জনসাধারণের উপকারে ব্যবহারের উপযোগী রাখা জরুরী। এতে অর্থনৈতিক ভাবে দু’দেশই লাভবান হবে। এ ধারা অব্যহত রাখতে আমদানি-রপ্তানি বাড়াতে কাজ করা জরুরী।
সমাপণীতে নাহিম রাজ্জাক, এমপি; ইন্ডিয়া পাউন্ডেশনের পরিচালক অলক বানশাল, কক্সবাজারের সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক বক্তব্য রাখেন। অন্যান্য সেশনে বক্তব্য রাখেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আলী শিকদার, হাসানুল হক ইনুসহ দু’দেশের অংশগ্রহণকারিরা বক্তব্য রাখেন। সমাপণীতে এসময় বিজেপি (ভারত) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব বারানাসী, ফ্রেন্ড বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর রিজিয়নাল স্ট্যাডির চেয়ারম্যান আ.স.ম সামশুল আরেফীন, স্থানীয় সাংসদ সাইমুম সরোয়ার কমল, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল (অব.) ফোরকান আহমদসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ এবং দু’দেশের সরকারি কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন ।
নয় সুপারিশ মালা সমেত ‘কক্সবাজার ঘোষণা’ করা হয়েছে। সুপারিশ গুলো হলো, ম্যানেজিং পিসপুল এন্ড প্রসফরাস ইন্টারন্যাশনাল বর্ডাও এন্ড সিকিউরিটি, ওয়াটার সিকিউরিটি এন্ড জয়েন্ট বেসিন ম্যানেজমেন্ট, এনার্জি সিকিউরিটি এন্ড ক্রসবর্ডাও জেনারেশন এন্ড ট্রেড ইন পাওয়ার, কানেক্টিভিটি এন্ড ইনটিগ্রেটেড মাল্টিমডেল কমিউনিকেশন উইথ স্পেশাল ইমপেসেস অন ইউটিলাইজিং ইন লেন্ড ওয়াটার ওয়েজ, সাব-রিজিয়নাল ডেভলপমেন্ট এন্ড ইউটিলাইজেশন অব মেগাঅ-আর্কিটেকসার সাচেস রিজিউনাল এন্ড কন্টিনেন্টাল হাইওয়েজ, রেল নেটওয়ার্ক, সি-পোর্ট এন্ড কোস্টাল সিপিং, ইনভেস্টমেন্ট প্রোডাকশন, ম্যানোফেকসারিং এন্ড সার্ভিস সেক্টও এন্ড কম্পপ্লিমেন্টারেটিস, এডুকেশন এন্ড হেল্থ সেকটর ডেভলপমেন্ট এন্ড ইলিমেনেশন অব ডিজিস, ম্যালোনিট্রেশন, ইলিটারেসি এন্ড ইগনুরেন্স, ডিজাইনিং সাসটেইনেভল এন্ড ফরোয়ার্ড লুকিং মেকিিনজম এন্ড জয়েন্ট ফিনান্স এন্ড মার্কেটিং অব লিডারশিপ এক্রস সাউথ এশিয়া টু ইনস্টিটিউট মেজারেবল স্যুশ্যাল ইকুনোমিক চেইন্জ।
কক্সবাজারের ইনানীর তারকা হোটেল রয়েল টিউলিপের বল রুমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর রিজিয়নাল স্ট্যাডি এবং ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ও ফ্রেন্ড অব বাংলাদেশ যৌথ আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব সংলাপ’র প্রথম দিন (শুক্রবার) উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত দু’দেশের সরকার সন্ত্রাসবাদ দমনে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই নীতি বিশ্বব্যাপি প্রশংসা পেয়েছে। ফ্রেন্ডশিপ সংলাপ দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করবে। এ লক্ষ্যে ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত রপ্তানী বাড়ানোর আহবান জানান স্পিকার।
সংলাপে মন্ত্রীসহ ভারতের ২৬ জন ও সাবেক মন্ত্রী সংসদ সদস্যসহ বাংলাদেশের ৫৪ জন প্রতিনিধিসহ স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় শতাধিক নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।
বাংলাধারা/এফএস/টিএম