আমদানিকৃত পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরিবহন করে লাইটার জাহাজ। সম্প্রতি এসব লাইটার জাহাজ পরিচালনা নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, যেখানে লাইটার জাহাজের সিরিয়াল ভুক্তি, বরাদ্দ ও ভাড়া নির্ধারণের একক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অডিশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি) নামে একটি বেসরকারি সংগঠনকে। কিন্তু প্রণীত এই নীতিমালার বিরোধিতা করেছে আমদানিকারক ও জাহাজ মালিকদের একাংশ।
তাদের আশঙ্কা, এ নীতিমালার ফলে নৌপথে আমদানিকৃত পণ্য পরিবহনে সম্প্রতি বন্ধ হওয়া সিন্ডিকেট ফের ফিরে আসবে। এটি প্রতিযোগিতা আইন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ব্যবসায়ীরা বলেন, এতদিন জাহাজের ভাড়া নির্ধারণ হতো আমদানিকারক ও জাহাজ মালিকদের দরকষাকষির ভিত্তিতে। নতুন সেল গঠন করায় এখন সে সুযোগ থাকছে না। এতে বাড়বে পরিবহন খরচ। ফলে পণ্যের দামও বাড়বে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে করে প্রতি বছর ১০ কোটি টনের বেশি পণ্য ৪০টি অভ্যন্তরীণ নৌপথে পাঠানো হয়। এক হাজার ৮০০-র বেশি লাইটার জাহাজ পরিবহনের কাজ করে। অভ্যন্তরীণ নৌপথে আমদানি করা পণ্য পরিবহনে জাহাজ পরিচালনায় ২০০৪ সালে তিন জাহাজ মালিক সংগঠন যৌথভাবে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) গঠন করে। সংগঠনগুলো হলো—বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, কোস্টাল শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও চট্টগ্রাম চেম্বার। পরে যুক্ত হয় চট্টগ্রামের ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনও।
এদিকে বন্দর থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহনে গত বছর ভেঙে দেওয়া হয় সিরিয়াল প্রথা। এতে পণ্য ৩৪ নৌরুটে পরিবহনে আগের তুলনায় ২০ শতাংশ খরচ কমে এসেছিল; কিন্তু গত ১৫ অক্টোবর নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত লাইটার জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্রবন্দরগুলোতে পণ্য পরিবহন নীতিমালা প্রণয়ন করায় এ ব্যয় ফের বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নতুন নীতিমালা অনুসারে, এখন থেকে লাইটার জাহাজ মালিকদের সংগঠনগুলো বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি)-এর অধীনে পরিচালিত হবে। লাইটার জাহাজ বরাদ্দে মালিক, আমদানি-রপ্তানিকারক, পণ্যের এজেন্ট, লোকাল এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সমন্বয়কারক হিসেবে কাজ করবে বিডব্লিউটিসিসি। বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম মনিটরিং করতে ১০ সদস্যের তদারকি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি থাকবেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা তার প্রতিনিধি। সদস্য সচিব অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক।
নীতিমালার শর্ত অনুযায়ী, বিডব্লিউটিসিসির বরাদ্দ ছাড়া কোনো লাইটার জাহাজ মাদার ভেসেল থেকে পণ্য পরিবহন করতে পারবে না। তবে শর্তসাপেক্ষে যেমন, যে ফ্যাক্টরি ও গ্রুপ অব কোম্পানির নিজস্ব লাইটার জাহাজ রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের অব্যাহতি পত্র সাপেক্ষে তাদের পণ্য নিজস্ব জাহাজে পরিবহনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা ভাড়া জাহাজ দিয়ে তাদের বহর বাড়াতে পারবে না অথবা তাদের বহরে থাকা কিন্তু কারখানার নামে নিবন্ধিত নয় এমন জাহাজে পণ্য পরিবহন করতে পারবে না।
সিকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, জুনে বিগত সরকার এমন সিন্ডিকেট করতে চেয়েছিল। সেই সিন্ডিকেট ফের করার চেষ্টা চলছে। মূলত তারা চাচ্ছে চাঁদাবাজি করতে। জাহাজের সিরিয়াল ব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনলে পুরো বিষয়টি তাদের কাছে জিম্মি হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যেখানে ৫৮৫ টাকা থেকে রেট কমেছে, সেখানে এখন বাড়ানোর বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। গত বছর সালমান এফ রহমানও এই সিন্ডিকেট করতে চেষ্টা চালিয়েছিল কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রামে লাইটার জাহাজ মালিক প্রতিষ্ঠান এএনজে ট্রেডিংয়ের ম্যানেজিং পার্টনার শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পণ্য পরিবহন নীতিমালা প্রণীত হলেও ভাড়ার তালিকা নির্ধারণ করা হয়নি। সব ধরনের পণ্যের আমদানিকারক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ভাড়া নির্ধারণ করা উচিত। আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় গমবাহী পণ্যের টনপ্রতি ভাড়া ছিল ৬৬২ টাকা। সেল ভেঙে যাওয়ায় এখন আমদানিকারক ও জাহাজ মালিকের পছন্দ এবং দরকষাকষির ভিত্তিতে জাহাজ ভাড়া নির্ধারিত হচ্ছে। টনপ্রতি ভাড়া কমেছে প্রায় ১৫০ টাকা। এতে আমদানিকারক এবং সাধারণ জাহাজ মালিকরা খুশি। নতুন সেল গঠন করে আবারও সিন্ডিকেটের হাতে পণ্য পরিবহন খাত তুলে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।
চট্টগ্রামের নৌযান মালিক সমিতির মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ বলেন, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বিলুপ্ত হওয়ায় আমদানিকারক ও জাহাজ মালিকরা পণ্য পরিবহন নিয়ে দরকষাকষি করতে পারছেন। এটি পরিবহন খরচ অনেক কমিয়ে দিয়েছে।
টি কে গ্রুপের হেড অব বিজনেস (গ্রেইনস অ্যান্ড লজিস্টিকস) সত্যজিৎ দাস বর্মণ বলেন, গত নয় মাসে জাহাজ মালিকদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে সময়মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক লাইটার জাহাজ পেতে ঝামেলা হয়নি। চট্টগ্রাম-ঢাকা নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ টনপ্রতি প্রায় ১২০ টাকা কমেছে। জাহাজের সিরিয়াল ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে এককভাবে একটি সংগঠনকে দিলে পুরোনো সিন্ডিকেশন ফিরে আসবে।
তবে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম জানান, বাণিজ্যে শৃঙ্খলা আনা ও সমান প্রতিযোগিতার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। একচেটিয়া আধিপত্য তৈরির সম্ভাবনা নেই। পর্যবেক্ষণ কমিটি নতুন সংগঠনের কার্যক্রম তদারকি করবে। সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার অভাবে জাহাজ মালিকদের একাংশ কম ভাড়ায় পণ্য পরিবহন করেছেন।
এদিকে লাইটার জাহাজ মালিক ও শ্রমিকদের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মুখে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরসহ অভ্যন্তরীণ নৌরুটে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হতে শুরু করেছে। গতকাল মঙ্গলবার বহির্নোঙর থেকে কয়েকটি জাহাজ ফিরিয়ে আনা এবং অভ্যন্তরীণ নৌরুটে চলাচলকারী কয়েকটি জাহাজকে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একপক্ষ নৌকা নিয়ে নদীতে মাইকিং করে জাহাজ চলাচল বিরত রাখার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অপর পক্ষ বলছে, চলমান কাজ শেষ করার পাশাপাশি ত্রিপক্ষীয় চুক্তিনামা সম্পাদন ও ভাড়ার বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের সংগঠন আইভোয়াকের পক্ষ থেকে সোমবার নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলা হয়েছে, আলাপ-আলোচনা ও ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ছাড়া সন্ত্রাসী কায়দায় নৌপরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাবে না। অপর দুই সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নীতিমালা অনুসরণ করে বিডব্লিউটিসিসি বাস্তবায়ন ছাড়া জাহাজ মালিকদের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। আগামী ১ বা ২ নভেম্বর থেকে বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করার লক্ষ্যে কাজ চলছে।
সূত্র: কালবেলা।