ksrm-ads

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ksrm-ads

ল্যান্ডলর্ড মডেলে প্রবেশ করছে চট্টগ্রাম বন্দর

বন্দর

নতুন দিনের অপেক্ষায় আছে চট্টগ্রাম বন্দর। আগামী মাসেই প্রথমবারের মতো কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের একটি টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালই (পিসিটি) বন্দরের প্রথম কোনো টার্মিনাল, যেটি পরিচালনা করবে বিদেশিরা। চুক্তির মাধ্যমে ২২ বছরের জন্য এটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই)। এ জন্য তারা বিনিয়োগ করবে ২৪ কোটি ইউএস ডলার।

এর মাধ্যমে টুল পোর্ট থেকে ল্যান্ডলর্ড মডেলে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। টুল পোর্ট পদ্ধতিতে বন্দর পরিচালনার যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। আর ল্যান্ডলর্ড পদ্ধতিতে সরকার শুধু প্রাথমিক অবকাঠামো তৈরি করে দেয়। এর পর যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি খাত।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছুর পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনের প্রয়োজনেই টুল পোর্ট থেকে ল্যান্ডলর্ড মডেলে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর। পিপিপি অ্যাক্ট অনুযায়ী, জিটুজি পদ্ধতিতে চুক্তি হয়েছে সৌদি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
রেড সি গেটওয়ে তাদের প্রস্তাবে বলেছে, পিসিটি পরিচালনায় ২৪ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে প্রতিষ্ঠানটি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। নিজেদের অর্থে যন্ত্রপাতি কিনে ২২ বছরের জন্য এই টার্মিনাল পরিচালনার চুক্তি করবে প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তির দিন থেকে এই ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, চুক্তি হওয়ার পর পরিচালনার কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে সাত সদস্যের একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত দুই মাস এই কমিটি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেছে। আগামী ৭ এপ্রিল কার্যক্রম শুরুর প্রাথমিক একটি তারিখও ঠিক হয়েছে। তবে এটি পরিবর্তন হতে পারে।

তিনি জানান, ৫৮৪ মিটার লম্বা পিসিটি টার্মিনালের তিনটি জেটিতে একসঙ্গে তিনটি কনটেইনার জাহাজ ভেড়ানো যাবে। তেল খালাসের জন্য রয়েছে পৃথক আরেকটি ডলফিন জেটি, যা লম্বায় ২০৪ মিটার। এ টার্মিনালে বছরে ২০ ফুট দীর্ঘ প্রায় পাঁচ লাখ কনটেইনার বাড়তি হ্যান্ডেল করতে পারবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এটি চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে। পাশাপাশি কমবে জাহাজের চাপও। পিসিটির ব্যবহার শুরু হলে বন্দরের টার্মিনালের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে চারটিতে। আবার জাহাজ নোঙর করানোর জন্য বন্দরের মূল জেটির সংখ্যা দাঁড়াবে ২১টিতে।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) ও আরএসজিটিআইর মধ্যে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পিসিটি টার্মিনাল বিশ্ব বাণিজ্যের প্রবেশ দ্বার হিসেবে কাজ করবে এবং আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের নতুন সুযোগ উন্মুক্ত করবে। আরএসজিটিআই সুনামের সঙ্গে জেদ্দা পোর্ট টার্মিনালসহ অন্যান্য টার্মিনাল পরিচালনা করছে। সেই দক্ষতা ও প্রযুক্তিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালটি পরিচালনা করবে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার দক্ষতা বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, প্রায় ২৬ একর জায়গায় কর্ণফুলী নদীর তীরে এ টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। এটির মাধ্যমে বন্দরের টার্মিনালের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চারটিতে। আর জাহাজ ভেড়ানোর জন্য বন্দরের মূল জেটির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১টিতে। পিসিটিতে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফট এবং দুইশ মিটার লম্বার জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। বন্দরের অন্য জেটিগুলোতে বর্তমানে সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফট এবং ১৯০ মিটার লম্বা জাহাজ ভিড়তে পারে।

চট্টগ্রাম বন্দরে সমুদ্রগামী জাহাজ ভেড়ানোর জন্য স্বাধীনতার পর দুটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। তিন দশক আগে নির্মিত চট্টগ্রাম বন্দরের চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালের (সিসিটি) নির্মাণকাজ করেছে ইউরোপীয় একটি প্রতিষ্ঠান। আর সর্বশেষ ২০০৭ সালে এ বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল তৈরির কাজ করেছে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। কিন্তু পিসিটি নির্মাণ করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান।

চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে পিসিটি নির্মিত হয়েছে। এই টার্মিনালের পূর্ত কাজের দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের। সেনাবাহিনী পূর্ত কাজের জন্য নিয়োগ দেয় দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। জেটি নির্মাণের জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিংকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ইয়ার্ডসহ অন্যান্য কাজেও দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। টার্মিনাল নির্মাণের চূড়ান্ত নকশা ও পরামর্শক ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।

টার্মিনাল তৈরি ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা দেশীয় প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ার টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, বিদেশিরা আর্থিক সামর্থ্য ও দক্ষতায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে। তবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তাদেরও সুযোগ দিতে হবে। তাহলে দেশের টাকা দেশেই থাকবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। তারা কত টাকা বিনিয়োগ করে আমাদের কত টাকা লাভ দেবে, সেটি নির্ধারণ করতে হবে বিচক্ষণতার সঙ্গে।
পিসিটি নির্মাণে ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিদেশিদের দিয়ে এটি পরিচালনা করলে বন্দরের প্রতি বছর কত টাকা আয় হবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট নয় কারও কাছে। বিদেশিরা কোন বছর কত টাকা বিনিয়োগ করবে, কোন বছরে কী যন্ত্রপাতি নতুন করে যুক্ত করবে, সে বিষয়টিও পরিষ্কার করতে হবে সবার সামনে।

বন্দরের মুখপাত্র ও সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বিষয়গুলো আমার জানা নেই। এটা মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। চুক্তির সঙ্গে যারা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন, তারা এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছেন।’ কিন্তু চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তাও সম্পষ্ট করে বলতে চাননি কিছু। জানি না বলে এড়িয়ে গেছেন তারাও।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান সরকার বলেন, ‘পিসিটি বঙ্গোপসাগরের একেবারে কাছাকাছি স্থানে। চট্টগ্রাম বন্দরের বাকি টার্মিনাল থেকে এটি প্রায় ৭ কিলোমিটার কাছে। যে কারণে আসা-যাওয়া মিলে ১৪ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে পিসিটি ব্যবহারকারীদের। এতে সাশ্রয় হবে জ্বালানি ও সময়। যার সুফল পাবে সবাই।’

তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে পিসিটিসহ বর্তমানে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ড্রাফটের (গভীরতা) জাহাজ ভেড়ানো যায় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে (এনসিটি)। এখানে সর্বোচ্চ ৯ মিটার থেকে সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যায়। সর্বশেষ নির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) নোঙর করানো যাবে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। যে কারণে বেশি মালপত্র নিয়ে জাহাজ এখানে ভিড়তে পারবে। বেশি কনটেইনার নিয়ে বড় জাহাজ নোঙর করার সুযোগ থাকায় পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে খরচ কমবে। সূত্র : সমকাল

আরও পড়ুন