সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
পর্যটকবিহীন দীর্ঘদিন ঝিমিয়ে থাকা কক্সবাজার আবারো সরব হয়ে উঠেছে। বড়দিনসহ টানা তিন দিনের ছুটিতে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। সাগর তীরে আনন্দে মেতেছেন ভ্রমণপিপাসুরা।
শুক্রবার (২৩ ডিসেম্বর) দেখা যায়, সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে সকাল থেকে পর্যটকরা ভিড় করেন। পর্যটকের ভিড় রয়েছে হোটেল- মোটেলের অলিগলিগুলোতেও। পর্যটকবাহী ও সাধারণ পরিবহন এবং ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশায় বাস টার্মিনাল বাইপাস সড়ক, কলাতলী ডলফিন মোড়, হোটেল-মোটেল জোন, লাবণী, শৈবাল সড়কে তীব্র যানজটেরও সৃষ্টি হয়েছে।
২০১৯ হতে ২০২১ সাল ‘করোনা দূর্যোগে’ মন্দা গেছে পর্যটন মৌসুম। হোটেল-মোটেলসহ সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ গেছে কক্সবাজার সৈকত ও আশপাস এলাকায়। তবে, গত বছরের শেষ সময়ে খুলেছে হোটেল-মোটেলসহ পর্যটনস্পট। এরপরই বিজয় দিবস ও চলতি বছরে ভাষা দিবস ঘিরে টানা ছুটিতে কিছুটা পর্যটক এসেছিল সৈকত নগরী কক্সবাজারে। কিন্তু এরপর বর্ষা, ঘূর্ণিঝড়সহ সব মিলিয়ে আবারো ভাটা পড়ে পর্যটনে। ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উদযাপন দিয়ে চলতি পর্যটন মৌসুম চললেও কক্সবাজারে আশানুরূপ পর্যটক উপস্থিতি নেই। নাইক্যংছড়ি-উখিয়া-টেকনাফে মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে সাম্প্রতিক সংঘাত ও নাফনদীতে নাব্যতা সংকটে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-পথে পর্যটকবাহি জাহাজ চলাচল বন্ধ। স্বল্প ব্যয় ও সহজপথে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ বন্ধ থাকায় কক্সবাজারে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পর্যটক উপস্থিতি নেই বললে চলে। ফলে, গেস্ট হাউজ, কটেজ ও ননস্টার হোটেলগুলো ফাঁকা-ই যাচ্ছে মৌসুমের এ সময়ে। এবারে বিজয় দিবসের ছুটি সপ্তাহিক বন্ধের দিন পড়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যটক উপস্থিতি হয়নি। এতে চরম হতাশায় সময় কেটেছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।
কিন্তু সেই হতাশায় আলো দেখাচ্ছে এবারের বড় দিনের ছুটি। সপ্তাহিক ছুটির সাথে বড়দিনের ছুটি এক হওয়ায় টানা তিনদিনের ছুটির সুযোগকে কাজে লাগাতে ভ্রমণ প্রেমীরা কক্সবাজার আসছেন। এ তিনদিনকে উপলক্ষ্য করে আগাম বুকিং নিয়েছেন হোটেল-মোটেল ও কটেজ কক্ষ। ব্যয়বহুল জেনেও অনেকে আগাম টিকেট কেটেছে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে চলা কর্ণফূলী ও বার আউলিয়া জাহাজ টিকেট। সেন্টমার্টিনেও এবারে আগাম কিছু বুকিং পেয়েছে সেখানকার হোটেল ব্যবসায়ীরা।
বড়দিন ও সপ্তাহিক মিলে তিনদিনের ছুটিতে কক্সবাজারে ৪-৫ লাখ পর্যটক উপস্থিতির আশা করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। এ তিনদিনে ভালো ব্যবসা হতে পারে বলেও আশা করছেন তারা।
অতিরিক্ত পর্যটক আগমন মাথায় রেখে সেভাবেই নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছে কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ। নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রাথমিক চিকিৎসা, তথ্য সেবা, পানীয় জলের ব্যবস্থাসহ নানা সেবামূলক কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের সিনিয়র এএসপি মিজানুজ্জামান চৌধুরী।
হোটেল মালিকদের বরাত দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, টানা ছুটিকে টার্গেট করে একসপ্তাহ আগে থেকে আগাম বুকিং হয়ে আছে পর্যটন কেন্দ্রীক সাড়ে ৪ শতাধিক হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট। এতে টইটম্বুর পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্তক অবস্থায় দায়িত্বপালনে মজুদ রয়েছে ট্যুরিস্ট ও জেলা পুলিশ। মোতায়েন রাখা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশও। যেকোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে পর্যটন স্পটগুলো। ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা ও খাবার পানির ব্যবস্থা রয়েছে সৈকত তীরে।
ট্যুর অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) সভাপতি মো. রেজাউল করিম বলেন, শুক্র-শনি-রবি তিন দিনের ছুটিতে কক্সবাজারের সিংহভাগ হোটেল আগাম বুকিং হয়েছে। পর্যটকরা অনলাইনে রুম চাইলেও দেয়া যাচ্ছে না। এই ছুটির দিনগুলোতে ঝিমিয়ে পড়া পর্যটন লাখো পর্যটকে আবারো সরব হয়ে উঠেছে।
কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে আসা পর্যটক দম্পতি আতিকুর রহমান সম্রাট ও আনিকা আমিন জানান, দীর্ঘদিন কোথাও যাওয়া হয়নি- তাই বড়দিনের ছুটিসহ টানা বন্ধ পেয়ে বাড়ির সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার এসে তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসে উঠেছি। আমাদের মতো আরো অনেকে এসেছেন বেড়াতে, হোটেলের প্রায় রুমে মানুষের উপস্থিতি তেমনটি মনে হচ্ছে।
তারকা হোটেল হোয়াইট অর্কিডের মহাব্যবস্থাপক রিয়াদ ইফতেখার বলেন, পর্যটন মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই কমবেশী পর্যটক কক্সবাজারে অবস্থান করেন। সরকারি দিবসের সাথে সপ্তাহিক ছুটি মিলে টানা ছুটি পেলে পর্যটক সমাগম বাড়ে। আর সপ্তাহিক ছুটিতে যদি বিশেষ দিবসগুলো পড়ে তখন আবার পর্যটক সমাগম হয় না বললেই চলে। খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বড়দিনের সাথে সপ্তাহিক ছুটি মিলে টানা বন্ধ পেয়ে একসাথে অনেক লোক বেড়াতে আসছেন। আমাদের হোটেল শুক্র ও শনিবার সম্পূর্ণ বুকড। পাশাপাশি কক্সবাজারের সাড়ে ৪ শতাধিক হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট আগাম বুকিং হয়েছে বলে খবর পেয়েছি।
কলাতলীর সী-নাইট গেস্ট হাউজের ব্যবস্থাপক শফিক ফরাজী বলেন, হোটেল-মোটেলে যে পরিমাণ ধারণ ক্ষমতা তার চেয়েও লোকসমাগম বেশি হবে এমনটি আশা করা যায়। রুম বুকিং করে যারা এসেছেন, তারা ছাড়া বাকিরা ভোগান্তিতে পড়তে পারেন। দেড় লাখাধিক লোক থাকার আয়োজন রয়েছে কক্সবাজারে। শুক্র-শনি-রবি তিনদিনে সৈকত শহর কক্সবাজারে ৪-৫ লাখের অধিক পর্যটকের আগমন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সী সেইফ লাইফ গার্ডের সুপারভাইজার মোহাম্মদ ওসমান বলেন, বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ সৈকতে নিয়মিত থাকেন। বন্ধের দিনে এ সংখ্যা বাড়ে। ঢেউয়ের তালে দাপিয়ে বেড়ান সববয়সী পর্যটক। তাদের নিরাপদ রাখতে সতর্কতায় থাকি আমরা।
তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস লিমিটেডের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু বলেন, করোনা আমাদের ঋণগ্রস্ত করেছে। বিজয় দিবসে পর্যটক উপস্থিতি বাড়বে ভেবেছিলাম। কিন্তু মৌসুম শেষ হতে চললেও এবারের পর্যটন মৌসুম আমাদের হতাশ করেছে। তবে, শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যটক উপস্থিতি আমাদের আশান্বিত করছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, পর্যটক নিরাপত্তায় সৈকত ও আশপাশে পোশাকধারী পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। সৈকতে বীচ বাইক নিয়েও রয়েছে টহল। রয়েছে ৩টি বেসরকারি লাইফ গার্ড সংস্থার অর্ধশতাধিক প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড কর্মী। কন্ট্রোল রুম, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারসহ পুরো সৈকত পুলিশের নজরদারির আওতায় রয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, পর্যটকদের সুবিধার্থে সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা, কলাতলীসহ প্রতিটি পয়েন্টে তথ্য কেন্দ্র স্থাপন হয়েছে। পর্যটক হয়রানি বন্ধে মাঠে থাকছে জেলা প্রশাসনের নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত। কোথাও পর্যটক হয়রানির অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, পর্যটকদের অনাকাঙ্খিত হয়রানি রোধে, পোষাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোষাকে এবং পর্যটক বেশেও পুলিশের নারী সদস্য সৈকতে ঘুরছেন। সব মিলিয়ে পর্যটক নিরাপত্তায় সবসময় সর্তকাবস্থায় রয়েছি আমরা।