এ বছরের সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের মধ্যে ‘ফেভারিট’ তালিকায় ছিলেন আনি আর্নো। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদি, কেনিয়ার লেখক নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গো, জাপানের হারুকি মুরাকামি ও নরওয়ের জন ফোসের মতো লেখক ও সাহিত্যিকদের হারিয়ে পুরস্কার জিতে নিয়েছেন আর্নো।
ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘সাহস ও পর্যবেক্ষণগত তীক্ষ্ণতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্মৃতির সমষ্টিগত সংযম, বিচ্ছিন্নতাবোধ ও শিকড় অনাবৃত করার জন্য আর্নোকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।’ ৮২ বছর বয়সী এ নারী নোবেল বিজয়ীর সাহিত্যকর্মগুলো অনেকাংশেই আত্মজীবনীমূলক। একই সঙ্গে সামাজিক বিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে তার লেখার ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে।
আর্নোকে পুরস্কৃত করার বিষয়ে সুইডিশ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘লিঙ্গ, ভাষা ও শ্রেণি সম্পর্কিত শক্তিশালী বৈষম্য দিয়ে চিহ্নিত জীবন তিনি ধারাবাহিকভাবে ও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিরীক্ষণ করেছেন।
তার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘লে আরমোয়ার বিড’ ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে ‘লে আনি’ প্রকাশ হওয়ার পর তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান। এটি ২০১৭ সালে ‘দ্য ইয়ার্স’ নামে ভাষান্তরিত হয়। বইটি সম্পর্কে অ্যাকাডেমি বলেছে, এটি তার সবচেয়ে উচ্চাকাঙক্ষী প্রকল্প, যা তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং একদল অনুসারী ও সাহিত্যিক শিষ্য এনে দিয়েছে।
গত বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেন তানজানিয়ার নাগরিক ঔপন্যাসিক আবদুর রাজ্জাক গুরনাহ। ঔপনিবেশিকতার প্রভাব নিয়ে তার আপসহীন ও সহানুভূতিশীল লেখনির জন্য তাকে এ স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত চতুর্থ উপন্যাস ‘প্যারাডাইসে’র জন্য তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলের সমাজে ভালোবাসা ও দুঃখের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে প্যারাডাইসে।
২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেন মার্কিন কবি লুইস গ্লাক। সুইডিশ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্লাককে পুরস্কার দেয়া হয়েছে তার নিরাভরণ সৌন্দর্যের ভ্রান্তিহীন কাব্যকণ্ঠের কারণে, যা ব্যক্তিসত্তাকে সার্বজনীন করে তোলে। ২০১৯ সালে নোবেল পুরস্কার পান অস্ট্রিয়ার বিতর্কিত লেখক পিটার হান্দক। তার বিরুদ্ধে সার্বিয়ার নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচের বলকান যুদ্ধ সমর্থনের অভিযোগ রয়েছে।
২০১৮ সালে পুরস্কার নিয়ে গুরুতর এক অভিযোগের পর বিতর্কের মুখে পুরস্কার ঘোষণা স্থগিত করে নোবেল কমিটি। মূলত কমিটির এক নারী সদস্যের স্বামীর বিরুদ্ধে। জনপ্রিয় আলোকচিত্রী জ্যঁ ক্লদ আর্নো নামে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন নোবেল বিজয়ীর নাম ফাঁস করার পাশাপাশি যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন আদালত।
বিজয়ী নাম ফাঁস কেলেঙ্কারির কারণে ২০১৯ সাল থেকে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে শুরু করে রয়েল সুইডিশ একাডেমি। পরিবর্তন আনা হয় নোবেল কমিটির কাঠামোতেও। ২০১৯ সালে ওই বছরের বিজয়ীর পাশাপাশি ঘোষণা করা হয় ২০১৮ সালের স্থগিতকৃত বিজয়ীয় নামও। ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান পোলিশ লেখক ওলগা তোকারজুক।
সরাসরি নোবেল ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৮ সালেই প্রথমবারের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা বাতিল করা হয়। এর আগে দ্বিতীয় ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ও এ বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তবে ওই সময় যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে দেয়া হয়নি।
২০১৭ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেন জাপানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক কাজু ইশিগুরো। ২০১৬ সালে অ্যাকাডেমি আমেরিকান রক সংগীতের কিংবদন্তি বব ডিলানকে এই পুরষ্কার দেয়া হয়। এর আগে ১৪ জন নারী সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। প্রয়াত টনি মরিসন একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ নারী যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন।
সাহিত্যে নোবেলসহ এ বছর এখন পর্যন্ত চারটি বিষয়ে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। গত সপ্তাহে (৩ অক্টোবর) চিকিৎসার নোবেলের মধ্যদিয়ে ঘোষণা শুরু হয়। চিকিৎসা শাস্ত্রে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডিশ বিজ্ঞানী সভান্তে পাবো। বিলুপ্তপ্রায় হোমিনিডস এবং মানব বিবর্তনের জিনোম সম্পর্কিত আবিষ্কারের জন্য সোমবার সভান্তে পাবোকে ফিজিওলজি বা মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।
এরপর ঘোষণা করা হয় পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল। এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী। মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) বিকেলে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে সুইডেনের স্টকহোমে রয়্যাল সুইডিস একাডেমি। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী হলেন: ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট, মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী জন এফ ক্লজার ও অস্ট্রিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্টন জেলিঙ্গার।
পদার্থবিদ্যার নোবেল কমিটি জানায়, কোয়ান্টাম প্রযুক্তির একটি নতুন যুগের ভিত্তি স্থাপন করায় অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট, জন এফ ক্লজার ও অ্যান্টন জেলিঙ্গারকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। বুধবার (৫ অক্টোবর) রসায়নে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে নোবেল কমিটি ফর কেমেস্ট্রি। এ বছর রসায়নে যৌথভাবে নোবেল জিতে নিয়েছেন ক্যারোলিন আর. বেরতোজি, মর্টেন মেলডাল ও কে. বেরি শার্পলেস।
নোবেল কমিটি জানায়, `ক্লিক কেমেস্ট্রি’ ও ‘বায়ো-অর্থোজোন্যাল কেমেস্ট্রি’র উন্নয়নে অবদান রাখায় ক্যারোলিন আর. বেরতোজি, মর্টেন মেলডাল ও কে. ব্যারি শার্পলেসকে এ বছরের রসায়ন নোবেল দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যদিয়ে অষ্টম নারী হিসেবে রসায়নে নোবেল জিতেছেন ক্যারোলিন আর. বেরতোজি। আর পঞ্চম বিজ্ঞানী হিসেবে দ্বিতীয়বার নোবেল পান কে. ব্যারি শার্পলেস। এর আগে ২০০১ সালে রসায়নে নোবেল পেয়েছিলেন তিনি। গত বছর রসায়নের নোবেল পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন লিস্ট ও ডেভিড ডব্লিউসি ম্যাকমিলান।
এবারের রসায়ন পুরস্কার বিজয়ীর মধ্যে একজন নারী থাকতে পারে এমনটাই আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল নোবেল কমিটি ফর কেমেস্ট্রি। বুধবারের ঘোষণার মধ্যদিয়ে সেই ইঙ্গিতই সত্য হলো। এর ফলে মেরি কুরি, জুলিয়া কুরি, ডরোথি হজকিন, আডা যোনাথ, ইমানুয়েলা কার্পেন্টিয়ার ও জেনিফার দৌদনাদের তালিকায় যোগ হলো ক্যারোলিন আর. বেরতোজির নাম।
আগামী ১৯ অক্টোবর অর্থনীতির নোবেল ঘোষণার মধ্যদিয়ে শেষ হবে এ বছরের ঘোষণাপর্ব। এরপর আগামী ১০ ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয়ীদের হাতে নোবেল পুরস্কার তুলে দেয়া হবে।
১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসে প্রখ্যাত আবিস্কারক আলফ্রেড নোবেল নিজের মোট উপার্জনের ৯৪% (৩ কোটি সুইডিশ ক্রোনার) দিয়ে তার উইলের মাধ্যমে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করেন। এই বিপুল অর্থ দিয়েই শুরু হয় পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান।
১৯৬৮ সালে তালিকায় যুক্ত হয় অর্থনীতি। সে বছর পুরস্কার ঘোষণার আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন আলফ্রেড নোবেল। আইনসভার অনুমোদন শেষে তার উইল অনুযায়ী নোবেল ফাউন্ডেশন গঠিত হয়। তাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় আলফ্রেড নোবেলের রেখে যাওয়া অর্থের সার্বিক তত্ত্বাবধান করা এবং নোবেল পুরস্কারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা করা। বিজয়ী নির্বাচনের দায়িত্ব সুইডিশ অ্যাকাডেমি আর নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটিকে ভাগ করে দেয়া হয়।