ইছহাক হোসেন »
বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম নগরীতে কর্মজীবী ও সাধারণ মানুষের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান বাহন গণপরিবহন। প্রয়োজনের তুলনায় এই নগরীতে গণপরিবহনের সংখ্যা কম থাকায় চরম দুর্ভোগে নগরবাসী। নগরীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ দুর্ভোগও বেড়েই চলেছে। তাই নগরবাসীর যাত্রা ভোগান্তি কমাতে ২০১৭ সালে ‘যত সিট, তত যাত্রী’ প্রতিশ্রুতিতে চালু হয় কাউন্টার ভিত্তিক গণপরিবহন ‘মেট্রো প্রভাতী’ স্পেশাল সার্ভিস।
নগরীর পতেঙ্গা থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত এই রুটে চলাচলের লক্ষ্যে ৫৫টি বাস ও ২০টির অধিক কাউন্টার নিয়ে মেট্রো প্রভাতী ব্যানারে চলাচল শুরু করে পরিবহন সংস্থাটি। পরবর্তীতে তারা আরো কিছু সংখ্যক বাস দিয়ে একই ধরনের সেবা চালু করে সোনার বাংলা স্পেশাল সার্ভিস নামে যার রুট নির্ধারণ করা হয় ভাটিয়ারী থেকে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড হয়ে নতুন ব্রিজ পর্যন্ত।
এই স্পেশাল সার্ভিসে কাউন্টার ছাড়া যাত্রী উঠা-নামা না করা, সিটের অতিরিক্ত যাত্রী বহন না করা, উন্নত সিট, পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক ফ্যান ও লাইট সম্বলিত গাড়ি প্রদান ইত্যাদি সুবিধাদির কথা বলে চালু হলেও সেসব সুবিধা পাচ্ছে না নগরবাসী। উল্টো ভাড়া নিচ্ছে দ্বিগুণ, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গাদাগাদি করে নেয়া হচ্ছে যাত্রী, শিক্ষার্থীদের হাফ-পাস নিয়ে গড়িমশি করা, টিকেট নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করেও গাড়ি না পাওয়া— এসব এখন নগরবাসীর নিত্যদিনের ভোগান্তি।
বিশেষায়িত যাত্রী সেবার নামে চালু হওয়া এই মেট্রো প্রভাতী এখন নগরবাসীর ভোগান্তি ও জনদুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। অফিস ছুটির সময় হলে মেট্রো প্রভাতীর রূপ পরিবর্তন হয়ে ‘লোকাল বাসে’ পরিণত হয়। তখন দ্বিগুণ ভাড়ায় টিকেট কেটেও পাওয়া যায় না খালি আসন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে মেট্রো প্রভাতীর প্রায় ৫০টি বাস নগরীতে নিয়মিত চলাচল করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চালক জানান, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটি গাড়ি কমপক্ষে চারটি রাউন্ড ট্রিপ দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে কর্তৃপক্ষ। গাড়ির প্রতিটি রাউন্ড ট্রিপে গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহনে আয় হয় গড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আর এই হিসেবের অনুপাত বলছে, প্রতি মাসে তাদের টিকিট বিক্রি হয় প্রায় ২ কোটি টাকার।
মেট্রো প্রভাতীর এসব দুর্ভোগের বিষয়ে মোহাম্মদ রাকিবুল নামে এক যাত্রী বলেন, ‘মেট্রো প্রভাতীর কাছে আমরা এক ধরনের জিম্মি। প্রথম দিক থেকে তারা ভালোই সার্ভিস দিচ্ছিল, কিন্তু দিন দিন যাত্রীর চাপ বাড়ায় সিট ছাড়াও দাঁড়িয়ে গাদাগাদি করে যাত্রী বহন করে। প্রায় সময়ই টিকিট কেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও গাড়ি পাই না। অথচ তারা চাইলেই প্রতিটি কাউন্টার থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রী নিতে পারে এবং সিট ছাড়া যাত্রীদের ভাড়া কমিয়ে দিয়ে সুশৃংখলভাবে পরিচালনা করতে পারে।’
‘আবার গাড়ি আসলেও প্রারম্ভিক কাউন্টার থেকে যাত্রীতে পরিপূর্ণ করে আসে, যার কারণে মাঝপথের কাউন্টারগুলোতে আমার মত যাত্রীদের পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। তার উপর কাউন্টার ম্যানেজার এবং গাড়ির সুপারভাইজারদের আচরণ তো বলার ভাষাই রাখে না, এমনকি টিকেট ফেরত দিতে চাইলে অনেক সময় গালাগালও করেন। এক প্রকার নিরুপায় হয়ে দ্বিগুণ টাকা দিয়েও ভোগান্তির শিকার হচ্ছি প্রতিনিয়িত।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ‘যাত্রীর আসন খালি না থাকলে তাদের উঠতে মানা করি, তারা কথা অমান্য করেই নিজ নিজ প্রয়োজনে আসন থাকলেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যান। এমনকি অনেক সময় সুপারভাইজাররা মানা করলে যাত্রীরা মারমুখী আচরণ করেন। একই গাড়িতে আসনসহ ও আসনবিহীন দুই ধরনের মূল্যের টিকেট বিক্রি করা একেবারেই অসম্ভব।’ এটি অযৌক্তিক বলে বিষয়টি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দেন তিনি।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালক মো. ফয়েজ উল্ল্যাহ বলেন, ‘বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব। তাছাড়া কোন ভোক্তা চাইলে লিখিতভাবে অভিযোগ জানালে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বাংলাধারাকে বলেন, ‘এর আগেও মেট্রো প্রভাতীর যাত্রী ভোগান্তি ও দ্বিগুণ ভাড়ার নামে টাকা লোপাটের বিষয়টি আলোচনায় আসলে আমরাও প্রতিবাদ জানিয়েছি। তবে মেট্রো প্রভাতী কর্তৃপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের টনক নড়েনি। আশাকরি, ভোক্তা অধিদপ্তর ও সিটি কর্পোরেশন বিষয়টি দ্রুত নজরদারিতে এনে যাত্রী ভোগান্তি লাঘবে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।’