ksrm-ads

২ ডিসেম্বর ২০২৪

ksrm-ads

হোয়ে পাউডার দিয়ে ফুলক্রিম মিল্ক বানাচ্ছে দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো!

শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত  »

দেশে হোয়ে পাউডার আমদানি করে ফুলক্রিম মিল্ক পাউডার হিসাবে বিক্রি করছে একটি চক্র। আর ফুলক্রিম মিল্ক পাউডারের নামে সাধারণ ভোক্তাদের খাওয়ানো হচ্ছে আমদানিকৃত এসব হোয়ে পাউডার। শুধু মিল্ক পাউডার না, আমদানিকৃত হোয়ে পাউডার দিয়ে কেক, বিস্কুট , আইসক্রিম, চকলেট তৈরি করে বাজারজাত করা হচ্ছে। প্রক্রিয়াকরণ খরচ ও কাঁচামালের দাম কম হওয়ায় প্রতারক চক্রটি হোয়ে পাউডার দিয়ে কৃত্রিম দুধ তৈরি করে বাজারজাত করছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বছরে হাজার মেট্রিকটন হোয়ে পাউডার আমদানি করে আসছে দেশের বিভিন্ন দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত সূত্রে এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

জানা গেছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ৩ হাজার ২২৮ দশমিক ৮৭৫ মেট্রিক টন হোয়ে পাউডার। এছাড়াও তার আগে অর্থাৎ ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত ২৬ হাজার ৮শ ৬৭ দশমিক ২২৫ মেট্রিকটন হোয়ে পাউডার আমদানি হয়েছে। যেখান থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ৪৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। তাছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব মতে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে হোয়ে পাউডার আমদানি হয়েছে ৩৩ হাজার ২১৭ টন। এসব হোয়ে পাউডার গুলো আমদানি করা হয়েছে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলংকা, তুর্কি, ডেনর্মাকসহ বিভিন্ন দেশ থেকে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস থেকে প্রাপ্ত তথ্য ঘেটে দেখা যায়, হোয়ে পাউডার আমদানিতে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপ। এছাড়া এই হোয়ে পাউডার আমদানি করছে মেঘনা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান তাসনিম কনডেন্সড মিল্ক, পারটেক্স গ্রপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ড্যানিশ কনডেন্সড মিল্ক, এম এইচ কনজ্যুমারস প্রডাক্টস, সামান্নাজ কনডেন্সড মিল্ক, নূর ডেইরি এন্ড ফুড প্রসেসিং, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ওমেগা কর্পোরেশন ফয়সল ট্রেডিং কোম্পানি, এম এইচ কনজ্যুমারস প্রোডাক্টস এনবি ডেইরি এন্ড কনজ্যুমারস প্রোডাক্টস, মোস্তফা এন্টারপ্রাইজ, রেদওয়ান ব্রাদার্স, গোল্ডেন ট্রেডিং, রাহাত কর্পোরেশন ঢাকা ট্রান্সপোর্ট এন্ড ট্রেডিং এবং রোমানিয়া ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেড, মেসার্স তালহা এন্টারপ্রাইজ সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গুলো।

এসব আমদানিকৃত হোয়ে পাউডার দিয়ে ফুলক্রিম মিল্ক পাউডার বানাচ্ছে দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো!
প্রাপ্ত তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, হোয়ে পাউডার আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি করছে দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। মানব দেহের ওজন বাড়ানোর ক্ষেত্রে হোয়ে পাউডারকে প্রোটিন হিসেবে ব্যবহারের কথা। কিন্তু আমদানি করা এসব হোয়ে পাউডারকে ফুলক্রিম মিল্ক পাউডার হিসেবে বাজারজাত করছে দেশের দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গুলো।

জানা গেছে, হোয়ে পাউডার হলো তরল দুধ তৈরির পর উচ্ছিষ্ট অংশ। যেটি অত্যন্ত নিম্ন মানের হওয়ায় উন্নত দেশ গুলোতে তরল দুধ তৈরির পর উচ্ছিষ্ট অংশকে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করে হোয়ে পাউডার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তবে বাংলাদেশে সে হোয়ে পাউডারকে সরাসরি দুধের সাথে মিশিয়ে বাজারজাত করে প্রতারণা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশে বারবার খাদ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, এরমধ্যে দুধের মান নিয়ে বারাবার প্রশ্ন তুলছেন ক্রেতা সাধারণরা। হোয়ে পাউডার শরীরের বিশেষ কোনো ক্ষতি না করলেও দুধের সাথে মিশ্রণের ফলে দুধের গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে প্রতিনিয়ত। তবে হোয়ে পাউডার পরিমাণ মত ব্যবহার না করলে সেটি অনেক ক্ষেত্রে শরীরে রোগ প্রতিরোধের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিতে পারে। এছাড়া প্রক্রিয়াকরণ খরচ ও কাঁচামালের দাম কম হওয়ায় এই হোয়ে পাউডার দুধের পরির্বতে ব্যবহার করা হচ্ছে আইসক্রিম, বিস্কুট, চকোলেটসহ অন্যান্য খাদ্য উৎপাদন সামগ্রী তৈরিতে। এছাড়া বর্তমানে সাধারণ মানের দুধ ও দই তৈরি করে বাজারজাত করছে একটি প্রতারক চক্র যেখানে এই হোয়ে পাউডার ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পাউডারের সাথে মিশ্রণ করা হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক পর্দাথ। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে টাইফয়েড, যক্ষ্ণা, লিস্টেরিওসিস, ডিপথেরিয়া, ব্রুসেলোসিস, জন্ডিসসহ নানা জটিল রোগব্যাধি।

হোয়ে পাউডার আমদানিতে সিংহ ভাগই বাংলাদেশের দুধ উৎপাদিত প্রতিষ্ঠান গুলো জড়িত থাকায় খুব সহজেই বলা যায়, দুধের সাথে মিশ্রণ করা হচ্ছে এই হোয়ে পাউডার।যদিও কোনো দুগ্ধ পণ্যের গায়ে সেটি উল্লেখ না থাকায় প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতা সাধারণ।

এই ব্যাপারে ক্যাব কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বাংলাধারাকে বলেন, হোয়ে পাউডার দুধ কিংবা অন্য কিছুর সাথে মিশিয়ে নিয়মিত ক্রেতা সাধারণের সাথে প্রতারণা করছে সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলো। এখানে নীতি বির্সজন দিয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠান গুলো শুধু হোয়ে পাউডার নয় আরো অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পর্দাথ মিশিয়ে পণ্য বাজারজাত করছে। বিষয়টি খাদ্য কর্তৃপক্ষের নজরে নিয়ে এসে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এছাড়া তিনি বিএসটিআইয়ের নিকট এই ব্যাপারে সহযোগিতা কামনা করেন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম হাউসের কমিশনার ফখরুল আলম বাংলাধারাকে বলেন, হোয়ে পাউডার কোনো অবৈধ পণ্য নয়। কেউ যদি এটিকে দুধের সাথে বা অন্য কিছুর সাথে মিশিয়ে বাজারজাত করে থাকে সে দায় সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টির অবশ্যই বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করেন। এছাড়া তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, কেউ যদি গম আমদানি করে গমের গুনগত মান নষ্ট করে তারপর বাজারজাত করে থাকে সে দায় কাস্টমস হাউসের নয়।

চট্টগ্রাম ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানান, অসাধু কিছু ব্যবসায়ী বাজারে ইদানীং হোয়ে পাউডার, ভেজিটেবল ফ্যাট বা রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে মারাত্মক ক্ষতিকর কৃত্রিম দুধ তৈরি ও বিক্রি করছে। এমনকি সাধারণ মানের মিষ্টি ও দধি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই অপাস্তুরিত দুধ ব্যবহার করে। এসব দুধের কারণে মানবদেহের নানা রোগবালাই হচ্ছে।

২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি আড়াই হাজার টন হোয়ে পাউডার আমদানি করেছে আবুল খায়ের গ্রুপ । এর পরপরই রয়েছে মেঘনা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান তাসনিম কনডেন্সড মিল্ক ২ হাজার ৩৪২ টন, পারটেক্স গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ড্যানিশ কনডেন্সড মিল্ক ১ হাজার ২০০ টন, এম এইচ কনজ্যুমারস প্রডাক্টস ৯০০ টন, সামান্নাজ কনডেন্সড মিল্ক ৬৯১ টন, নূর ডেইরি এন্ড ফুড প্রসেসিং ৪০০ টন, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ৩২২ টন, ওমেগা কর্পোরেশন ২২৫ টন, ফয়সল ট্রেডিং কোম্পানি ১০০ টন, এম এইচ কনজ্যুমারস প্রোডাক্টস ৫০ টন, এনবি ডেইরি এন্ড কনজ্যুমারস প্রোডাক্টস ৫০ টন, মোস্তফা এন্টারপ্রাইজ ৫০ টন, রেদওয়ান ব্রাদার্স ২৫ টন, গোল্ডেন ট্রেডিং ২৫ টন, রাহাত কর্পোরেশন ২৫ টন, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট এন্ড ট্রেডিং ১৬ টন এবং রোমানিয়া ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেড আমদানি করেছে ৫ টন হোয়ে পাউডার ।

চলতি বছরের গত দুই মাসেও (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) সবচেয়ে বেশি ৩৮৫ টন হোয়ে পাউডার আমদানি করে শীর্ষে রয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের মিল্ক প্রোডাক্টস লিমিটেড । একই সময়ে সামান্নাজ কনডেন্স মিল্ক ১০০ টন, মেঘনা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান তাসনিম কনডেন্সড মিল্ক লিমিটেড ৪২ টন এবং মেসার্স তালহা এন্টারপ্রাইজ, ওমেগা কর্পোরেশন ও রেদওয়ান ব্রাদার্স যথাক্রমে ২৫ টন করে হোয়ে পাউডার আমদানি করেছে ।

বাংলাধারা/এফএস/এআর

আরও পড়ুন