হাসান সৈকত »
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যেন বেড়েই চলেছে চিনির দাম। ১০ দিনের ব্যবধানে খোলা চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে ৩৫ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে চিনির এমন অতিরিক্ত দামের পাশাপাশি বাজারে দেখা দিচ্ছে চিনির সংকট। আমদানিকারীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এখন চিনির দাম অনেকটাই বেশি। এ কারণে আমদানি নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন তারা। চিনির বাজারের এমন অস্থির পরিস্থিতিতেও চুপচাপ চিনি উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকরা। এমন কি সরকারি সংস্থাগুলোও নীরব। তবে চিনির দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ায় চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন ভোক্তারা।
গত ৮ এপ্রিল সরকার চিনির এমন বাড়তি দাম ঠেকাতে নির্ধারণ করে দিয়েছে চিনির নির্দিষ্ট একটি মূল্য তালিকা। প্রতি কেজি খোলা চিনির জন্য ১০৪ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির জন্য দাম নির্ধারন করা হয় ১০৯ টাকা। যদিও প্রথম থেকেই এই মূল্যের কঠোর বিরোধিতা করে আসছেন ভোক্তারা।
চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারের বেশির ভাগ মুদি দোকানগুলোতে প্যাকেটজাত চিনি নেই বললেই চলে। এমনকি খোলা চিনিরও সংকট রয়েছে বাজারে। চিনির এমন বাড়তি দাম ও সংকটের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। এক কেজি চিনি কিনতে ভোক্তাদের দিতে হচ্ছে চড়া মূল্য। ১০ দিন আগেও চিনির সর্বোচ্চ মূল্য ছিল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। তবে ১০ দিনের ব্যবধানে বাজারে এখন চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকায়।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, সরবরাহ সংকটের কারণেই বাজারে চিনির দামের এই অস্থিরতা। দোকানিদের সাথে কথা হলে তারা জানান, চিনির সরবরাহ না থাকায় তাদের অনেকেই আপাতত চিনি বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। আর যেসব দোকানে চিনি বিক্রি হচ্ছে, সেসব দোকানে ঈদের আগেই এসব চিনি কিনে রেখেছিলেন। বর্তমানে দু-একজন বিক্রেতা চিনি পেলেও অধিকাংশ বিক্রেতাই তাদের চাহিদা মতো চিনি পাচ্ছেন না। কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা অন্য পণ্যের অর্ডার নিলেও চিনির সরবরাহ নেই বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছে।
নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি পর্যায়ে কেনা খোলা চিনি এখন প্রতি কেজি ১৩০ টাকার বেশি। তার উপরে আবার ডিলাররা বিক্রিয়ের পর কোনো প্রকার রশিদ দিচ্ছেন না খুচরা ব্যাবসায়ীদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার দোকানে প্যাকেটজাত চিনি নেই আজকে অনেক দিন। গত মাসের শেষ দিকে ঈদুল ফিতরের পর থেকে চিনির সরবরাহ নেই বললেই চলে। খুচরা বাজারে এখন প্যাকেটজাত চিনি কমই পাওয়া যাচ্ছে।’
রিয়াজুদ্দিন বাজারের একটি মুদি দোকানের বিক্রয়কর্মী মনির বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই বাজারে চিনির সংকট। ঈদের পর সংকট যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে দাম। আমরা আপাতত বিক্রি বন্ধ রেখেছি।’
চৌমুহনীর কর্নফুলি বাজার ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ দোকানে প্যাকেটজাত চিনি নেই। গত মাসের শেষ দিকে ঈদুল ফিতরের পর থেকে চিনির সরবরাহ নেই বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে চিনির মিল মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, দেশে চিনির কোনো সংকট নেই, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম একটু বেশি। এ অবস্থায় চিনিকলের মালিকরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এক চিঠির মাধ্যমে তাদের এমন উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল ফটকে দিনের পর দিন ট্রাক বসিয়ে রেখেও চাহিদা অনুযায়ী চিনি মিলছে না। ফলে বাজারে তৈরি হচ্ছে বাড়তি সংকট।
তবে মিল থেকে চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দামে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আমরা বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছি।’
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় চিনি আমদানি নিয়ে তারাও ভুগছেন সিদ্ধান্তহীনতায়।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনির দাম ৬৭৫ মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭১৮৮৩ টাকা। অথচ এক মাস আগেও তা ছিল ৫২০ ডলার। অর্থাৎ, ৫৫৩৬১ টাকা। এই বাস্তবতায় চিনি আমদানির ঋণপত্র খুলতে ‘ভীতির সম্মুখীন’ হচ্ছেন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। কারণ, বর্তমান দামে চিনি আমদানি করলে তাতে প্রতি কেজিতে সব মিলিয়ে খরচ পড়বে প্রায় ১৩১ টাকা।’
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক মাসে চিনির দাম ১৫ শতাংশ বেড়েছে, এক বছরে তা বেড়েছে ৬২ শতাংশের বেশি।
তুরস্ক থেকে সাড়ে ১২ হাজার টন চিনি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ৮২ টাকা ৮৯ পয়সা কেজি দরে কেনা হবে এই চিনি। আগের তুলনায় প্রতি কেজি চিনি কিনতে প্রায় ৬ টাকা কম খরচ হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) জন্য এ চিনি কেনা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এই অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এতে মোট খরচ ধরা হয়েছে কোটি ৬৪ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. মফিজুল হক বলেন, ‘কোম্পানিগুলো জানিয়েছে চিনির উৎপাদন নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন প্রতি টন অপরিশোধিত দাম দাঁড়িয়েছে ৬৭০ ডলারে, যা আগে থেকে প্রায় ১০০ ডলার বেশি। তাই আমদানি কমেছে।’













