৮ ডিসেম্বর ২০২৫

আনোয়ারায় পল্লী বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইনে বাড়ছে মর্মান্তিক মৃত্যু ও দুর্ঘটনা

"অপসারণের জন্য আবেদন করলে অতিরিক্ত অর্থ দাবির অভিযোগ গ্রাহকদের"

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পল্লী বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইনগুলো সংস্কার না করার কারণে বেড়েছে মর্মান্তিক মৃত্যু ও দুর্ঘটনা।

আনোয়ারার বিভিন্ন সড়ক ও জমির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক লাইনের খুঁটিগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে হেলে পড়েছে।

এতে করে বিগত কয়েক মাসে আনোয়ারার বিভিন্ন জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইনে বিদ্যুতায়িত হয়ে মর্মান্তিকভাবে মারা গেছেন অনেকে।

বিশেষ করে আনোয়ারার উপকূলীয় অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ এবং লাইন অপসারণ আবেদন করতে গেলে অনেক কর্মকর্তা অবৈধভাবে অর্থ দাবি করেন বলে অভিযোগ করেন গ্রাহকেরা।‎

অনুসন্ধানে জানা যায়, কয়েক বছর যাবৎ ঘূর্ণিঝড় ও আবহাওয়ার প্রতিকূলতায় বয়ে যাওয়া ঝড়-বাতাসের কারণে আনোয়ারা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এই ধরনের অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইন ও হেলে পড়া খুঁটি রয়েছে।

যেগুলো নিয়ে আনোয়ারা পল্লী বিদ্যুৎ জোনাল অফিস বরাবর একাধিক অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। বরং অভিযোগকারীদের কাছ থেকেই লাইন সরানোর নামে বড় অঙ্কের অর্থ দাবি করা হয়েছে বলে জানান গ্রাহকেরা।

আনোয়ারা বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে প্রতিনিয়ত মানুষকে জীবনঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় গ্রাহকেরা। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ লোডশেডিং, অনিয়মিত বিদ্যুৎ বিল তৈরি, লাইনের কাজ করিয়ে দেওয়ার জন্য ঘুষ দাবি করার অভিযোগও বহুল প্রচলিত বলে জানান গ্রাহকেরা।

গত কয়েকদিন আগে উপজেলার বারশত স্কুল গেটের আগে সড়কের উপর ঝুঁকিপূর্ণ ৩৩ হাজার লাইনের খুঁটি হেলে পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর টনক নড়ে বিদ্যুৎ অফিসের। দীর্ঘ দিনের এই সমস্যা নিয়ে গ্রাহকেরা অভিযোগ করলেও সংবাদ প্রকাশের পর তাড়াহুড়া করে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় কর্তৃপক্ষের। স্থানীয়দের অভিযোগ, আর কত প্রাণহানি হলে বিদ্যুৎ বিভাগের টনক নড়বে।‎

গত রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) পরৈকোড়া ইউনিয়নে আসমা আক্তার নামের এক গৃহবধূ ঘরের ছাদের উপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারে বিদ্যুতায়িত হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ঘরের ছাদের উপর দিয়ে যাওয়া ওই ঝুঁকিপূর্ণ হাই-ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক তার সরাতে দেড় লাখ টাকা দাবি করেছে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। গত ৭ বছর আগে থেকেই ভুক্তভোগীরা বারবার লিখিত ও মৌখিকভাবে আবেদন জানালেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

সেই অবহেলার বলি হিসেবে গুনতে হলো ওই পরিবারের গৃহবধূ আসমা আক্তার (২৫) কে। নিহতের শ্বশুর মাস্টার আশরাফ আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ২০১৮ সালে প্রথম লিখিত অভিযোগ করেছিলাম। এরপর বহুবার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি।

বরং একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল, লাইন সরাতে আমাদের এক লাখ তেতাল্লিশ হাজার টাকা দিতে হবে। অথচ সরকারি খরচ বাবদ আমি ১৭শ টাকা জমা দিয়েছিলাম। আমাদের গৃহবধূর এই মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা বিদ্যুৎ বিভাগের অবহেলা ও দুর্নীতির নির্মম পরিণতি।

এর আগেও পরৈকোড়া ইউনিয়নে গোয়াল ঘরে কাজ করতে গিয়ে হাই-ভোল্টেজ তারে জড়িয়ে প্রাণ হারান কলেজ শিক্ষার্থী মাসুদুল হাসান রানা (২৪)। গত মাসের ৪ আগস্ট রোববার দিবাগত রাত ১২টার দিকে উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার শাহাব বানুর বাপের বাড়ি এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের একটি তারে হঠাৎ আগুন লাগে। খুঁটি থেকে তার ছিঁড়ে নিচে পড়ে যায়। আগুন দেখে স্থানীয় লোকজন চিৎকার শুরু করে।

এ সময় তাড়াহুড়া করে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে মনির হোসেন ছেঁড়া তারটিতে জড়িয়ে পড়েন। মুহূর্তেই তার হাত, ঊরু ঝলসে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। এতে তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেবে বলে বললেও একাধিকবার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে তার পরিবার এসে হয়রানির শিকার হয় বলে জানান ওই পরিবার। চলতি মাসে ৮ সেপ্টেম্বর বরুমচড়া গ্রামে ঘরের পাকা দেওয়াল নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে হানিফ (২০) নামের আরেক যুবকের মৃত্যু হয়।

উক্ত বিষয়ে আনোয়ারা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডিজিএম মো. মোরশেদুল ইসলাম জানান, বৈদ্যুতিক লাইনে বিদ্যুতায়িত হয়ে কেউ যদি মারা যায়, সেটার কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম নেই। লাইন অপসারণের জন্য গ্রাহক আবেদন করলেও অফিসের নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহককে ডিমান্ড বহন করতে হবে।

লাইন খরচ অফিস বহন করে না। আনোয়ারার যে সকল স্থানে বৈদ্যুতিক লাইন ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে আমরা সেগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি। আমার অফিসের কেউ যদি গ্রাহক থেকে কোনো ধরনের অনৈতিক সুবিধা নেয়, সেটা লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং আমি বিষয়টি অবগত আছি। আনোয়ারা উপজেলার যেসব স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগ রয়েছে, তা অপসারণে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন