মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »
ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানীকৃত চারশ কোচ এখন আস্তে আস্তে রেল কর্তপক্ষের গলার কাঁটা হয়ে দাড়াচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে ২০ বছর আগে চীন থেকে আনা কোচের তুলনায় নিম্নমানের এখনকার ইন্দোনেশিয়ান কোচ। সম্প্রতি রেলওয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এমপি সম্প্রতি ঢাকঢোল পিটিয়ে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ময়মননিসংহগামী বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেন ও কমলাপুর স্টেশন থেকে রেল মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন নোয়াখালীগামী উপকূল এক্সপ্রেস উদ্বোধন করেছেন। এর আগে এ্যাশ কালারের চীনা কোচ দিয়ে চাঁদপুরগামী মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেন চালু করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, প্রথম দফায় আনা ১৫০ টি কোচের ৩৫টি ত্রæটি সারানোর আগেই আবার ২০০ নতুন কোচের চুক্তি করা হয়েছিল।২০১৬ সালে আসা এসব কোচ দিয়ে ট্রেন চলাচলের মাত্র ২ মাসের মধ্যে প্রথমে ১৪টি ত্রæটি দেখিয়ে তৎকালীন রেলের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সরদার শাহদাত আলীর পক্ষ থেকে রেলের ডিরেক্টর জেনারেল(ডিজি) বরাবর লিখিত অভিযোগ করা হয়। ফলে রেল সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান এ বি এম ফজলে করিম এমপি’র সভাপতিত্বে আয়োজিত এক বৈঠকের সিদ্ধান্তে ইন্দোনেশিয়ার প্রজেক্ট ম্যানেজার বরাবর চিঠি লেখা হয়।
২০১৬ সালের পর দুই বছর যেতে না যেতেই বায়ো টয়লেটগুলো কাজ করছে না টয়লেটের হাই কমোডে ময়লায় জরাজীর্ণ। প্যান কমোডের টয়লেটেও বেহাল দশা। টয়লেটের পানির কল বা স্টীল বিক কক নষ্ট। তা পরিবর্তন করে লাগানো হচ্ছে মাত্র ১০ টাকা দামের পাøাস্টিকের বিককক। টিস্যু স্ট্যান নষ্ট রশি দিয়ে ঝোলানো হচ্ছে টিস্যু রোল। ইলেকট্রিক ইক্যুইপমেন্টগুলো ক্রমশ ভেঙ্গে যাচ্ছে। টয়লেটের দরজায় অটো সিগন্যাল নষ্ট, লকও নষ্ট। এছাড়াও কেবিনের ইলেকট্রিক সকেটগুলোও কাজ করছে না। কোচের দরজা দিয়ে উঠানামার হাতল স্টিল কালার হলেও মূলত লোহার হাতর ফলে মরিচা ধরেছে।

ঢাকাস্থ রেল ভবনে থাকা ডিরেক্টর জেনারেলের দফতর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষে তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আর এস/ রোলিং স্টক) সামছুজ্জামান ও ইন্দোনেশিয়ার ইনকা পিটি ইন্ডাস্ট্রিজ এর পক্ষে আর আগুস এইচ পুরনোমা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন রেল মন্ত্রী মুজিবুল হক। এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত রিনা পি সোয়েমার্নো ও রেলের তৎকালীন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেনসহ প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুন অর রশীদ।
বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ান কোচের জন্য সর্বপ্রথম চুক্তি হয়েছিল ২০১২ সালে। এ চুক্তিতে এক হাজার ৮২ কোটি টাকায় ১০০টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ কোচ সরবরাহ করে ইনকা। এই প্রকল্পের অর্থ এডিবি ৮০০ কোটি টাকা ও সরকার ২৮২ কোটি টাকা সরবরাহ করে। ২০১৬ সালে এসব কোচ সরবরাহ শেষ করে ইন্দোনেশিয়ার ইনকা পিটি। ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা মিটারগেজ ৩৫০টি ও ব্রডগেজ ৫০টি কোচ নিয়ে বিপাকে রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল। ২০২০ সাল পর্যন্ত সর্বশেষ চালানে আসা ২০০ মিটারগেজ কোচের বায়ো হাই কমোডগুলো প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। এ নিয়ে টয়লেটে প্রবেশের পর বিপাকে পড়ে যান ভিআইপিরা। কোটি টাকার এসব কোচের ক্ষতি গুনছে সরকার।

প্রথম বায়ো কমোডযুক্ত টয়লেট সম্বলিত মিটারগেজ কোচ ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা হয়েছে ২০১৯ সালের আগস্টে। ইন্দোনেশিয়ার সুরাবাইয়া সমূদ্র বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এরপর পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় পাহাড়তলীস্থ ক্যারেজ ও ওয়াগন কারখানায়। উল্ল্যেখ, বায়ো টয়লেট যুক্ত ২০০ কোচ ক্রয়ে মোট ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। মোট ২০ থেকে ৩৩টি চালানে এসব কোচ ২০২০ সালের জুলাইয়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছার কথা থাকলেও ‘কভিড-১৯’ এর কারনে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, কোন ধরনের কায়িক পরীক্ষা না করেই চলাচল উপযোগী ঘোষনা দিয়ে রেলপথে যুক্ত করা হয় এসব কোচ। রেল ট্র্যাকে ব্যবহারের সক্ষমতা যাচাই না করে পরিচালন বিভাগে যুক্ত করায় ঘটছে নানা বিপত্তি। বিশেষ করে এসব কোচ দিয়ে এখন পরিচালনা করা হচ্ছে সুবর্ণ এক্সপ্রেস, সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ও তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস। ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই তারিখে ২০০ মিটার গেজ কোচের মধ্যে ২৮টি কোচের প্রথম চালান চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আনার পর ১৬/৩২ লোড দিয়ে ওই বছর ঈদুল আযহার সময় যাত্রীদের জন্য রংপুরে একটি আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা হয়। তবে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।

আরো অভিযোগ রয়েছে, নতুন এসব কোচের প্রথম চালানে আসা ২৮টি কোচ লোডিং ক্যাপাসিটি ট্রায়াল না করেই কিভাবে ট্রেন পরিচালনায় দেওয়া হলো তা প্রশ্নবিদ্ধ। ২০২০ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের মধ্যে মোট নয়টি চালানে মিটারগেজ লাইনের সবগুলো কোচ পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছায়। এর আগে ব্রডগেজ লাইনের ৫০টি কোচ এসেছিল রেলের পশ্চিম জোনের জন্য।
এদিকে, ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন রেলের পূর্বাঞ্চলের পাহাড়তলীস্থ ক্যারেজ এন্ড ওয়াগন শপ কারখানা পরিদর্শন করেন। ওই সময় তিনি কারখানার প্রত্যেকটি শপ ঘুরে ঘুরে দেখেন। এই কারখানায় ব্রডগেজ লাইন স্থাপনের জন্য বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এফ. এম মহিউদ্দিনকে নির্দেশ দেন। একই সময়ে তিনি লোকমোটিভ কারখানা তথা ডিজেলশপও পরিদর্শন করেন। ইন্দোনেশিয়া থেকে ৫০টি ব্রডগেজ ও ২০০টি মিটারগেজ কোচ আমদানী করার পর ১৫টি আন্তঃনগর ট্রেন চালু করার কথা সারাদেশে। কিন্তু কোথায় ? কোচ আসলেও নতুন আন্তঃনগর ট্রেনের দেখা মিলেনি আদৌ।
ঢাকাস্থ রেল ভবনে থাকা মিটারগেজ বা এমজি ২০০ কোচের কস্ট স্টেটম্যান্ট অনুযায়ী দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০০টি স্টিলবডির যাত্রীবাহি মিটারগেজ কোচ আমদানীর চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। রেল ভবনে বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার ইনকা পিটি ইন্ডাস্ট্রী কারিটা এপিআই(পার্সিরো)। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ৭৩ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ইউ এস ডলার বা ৫৭৯ কোটি ৩৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকায় এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রত্যেকটি কোচের দাম পড়েছে প্রায় ৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। ক্রয় চুক্তিতে ইন্দোনেশিয়া ২০ হতে ৩৩ মাসের মধ্যে কোচ সরবরাহের চুক্তি ছিল।

রেল ভবনের এমজি কোচের প্রকল্প পরিচালকের দফতর সূত্রে জানা গেছে, ইন্দোনেশিয়ার প্রথম চুক্তির ১৫০ টি কোচ ট্রায়াল শেষে ২০১৭ সালে চলাচল শুরু করার মাত্র দুই মাসের মধ্যে ৩৫টি বিভিন্ন ত্রুটিদেখা দেয়। এই কোচগুলোতে ত্রæটির বিষয় জানিয়ে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয় ইন্দোনেশিয়ার প্রজেক্ট ম্যানেজার মি.সুটোরো’র কাছে বিআর/এডিবি-২/৫০বিজি এর ব্যাপারে ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট। ত্রুটি সংশোধনের বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে এই প্রজেক্ট ম্যানেজারের এর পক্ষ থেকে আরেকটি চিঠি ইনকা-বিআর-২/০০৮/২০১৭ প্রেরণ করা হয় ২০১৭ সালের ১১ আগস্ট। এখন পর্যন্ত কোন ধরনের ক্ষতিপূণ দেয়নি ইন্দোনেশিয়ার ইনকা পিটি ইন্ডাস্ট্রি কারিটা এপিআই(পার্সিরো)।
এদিকে, ৩৫টি ত্রুটি দেখা দেয়ার কারনে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট তারিখে ইন্দোনেশিয়ার ইনকা পিটি এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মি.সুটোরো বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়।ওই চিঠিতে উল্ল্যেখ করা হয়েছে, ১০০ এমজি কোচের চুক্তি নং-বিআর/এডিবি/১০০ এমজি এবং ৫০ বিজি কোচের চুক্তি নং- বিআর/এডিবি/৫০বিজি ক্যারেজ এর আওতায় দুটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয় ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর। এই দুটি চুক্তির আওতায় আসা ১৫০ ইন্দোনেশিয়ান কোচ প্রত্যেকটিতে প্রায় ৩৫ ধরনের ত্রুটি রয়েছে।













