রবিউল হোসেন রবি »
গত ২৪ জুন চট্টগ্রামের ইপিজেডের বন্দরটিলা এলাকার ‘সুইটস ড্রীম’ নামে একটি রেস্টুরেন্টে যায় পুলিশের একটি টিম। অভিযোগ— ওই রেস্টুরেন্টে চলছে অসামাজিক কার্যকলাপ। এরপরই ওই রেস্টুরেন্টে আসা কয়েকজন তরুণ-তরুণীকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে বিষয়টি রফাদফা করতে আটক প্রত্যেকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের ‘টাকা খেয়ে’ তাদেরকে ছেড়ে দেয় থানা পুলিশ।
এদিকে আটকদের ছেড়ে দেয়ার জন্য টাকা লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক এএসআই টাকা নেয়ার বিষয়টির স্বীকারোক্তি দিলেও বাংলাধারা প্রতিবেদককে নিউজ না করার অনুরোধ জানান। তার দাবি— ওসির নির্দেশেই তিনি সেই রেস্টুরেন্টে অভিযানে গেছেন এবং আটকদের পক্ষ হয়ে আসা লোকদের সঙ্গে তিনি ‘ডিল’ করেছেন।
জানা যায়, ২৪ জুন সন্ধ্যা ৭টার দিকে বন্দরটিলা এলাকার ‘সুইটস ড্রীম’ নামে একটি রেস্টুরেন্টে যায় ইপিজেড থানা পুলিশের একটি টিম। সেখানে গিয়ে তারা দাবি করেন ওই রেস্টুরেন্টে অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে। এরপর তারা ভয়-ভীতি দেখিয়ে অন্তত ৮ জন তরুণ-তরুণীকে সেখান থেকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। এরপর তাদের পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ‘টাকা খেয়ে’ ছেড়ে দেয় থানা পুলিশ।
ওই ঘটনার পর টাকা লেনদেন করার একটি ভিডিও ফুটেজও এসেছে বাংলাধারার প্রতিবেদকের হাতে। যে ভিডিওতে দেখা যায়, আটক একজনকে ছাড়তে কয়েক দফায় দর কষাকষি করছেন ইপিজেড ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) গোলাম মোস্তফা।
ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ওই রাতেই আটক এক তরুণের পক্ষ হয়ে তার কয়েকজন বন্ধু যায় ইপিজেড থানায়। পরে ইপিজেড ফাঁড়ির এএসআই মোস্তফা তাদেরকে থানার বাইরে লেবার কলোনি সংলগ্ন মাঠে পার্ক করা একটি কনটেইনারের পাশে নিয়ে যান। এরপর বিষয়টি ‘সমঝোতা’ করতে তাদের কাছে টাকা দাবি করেন তিনি।
এসময় ভিডিওতে এএসআই মোস্তফাকে বলতে শোনা যায়, ‘যেকোনো একজন আমার সঙ্গে আইসা কথা বলো, যে কথা বলবা একজন আইসা বলো।’ এরপর আটক তরুণের দুই বন্ধু যান তার কাছে। এসময় তিনি তাদের কাছে ১৫ হাজার টাকা দাবি করেন। কিন্তু এত টাকা দিতে গড়িমসি করায় ওই এএসআই প্রথম দফায় পাঁচ হাজার কমান।
ভিডিওতে ওই পুলিশ সদস্যকে বলতে শোনা যায়, ‘এ ভাই শোনো, এখনকার কথা হচ্ছে ক্লিয়ার। এখানে হাতি-ঘোড়া বড় ধরনের কোন চাহিদা নাই। ঠিকাছে? এখানে কোন কথার দরকার নেই। এখানে কোন হাতি-ঘোড়া না বা একলাখ টাকা— এরকম কোন চাহিদা নাই। মনে করো যে ছোট-খাট, ১০ হাজার দিও।’
ওই তরুণ এত টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ওই এএসআই বলেন, ‘শোনো এটা কি খালি আমার পকেটে ঢুকবে? এখানে ওসি স্যার নিজে ঘটনাস্থলে গেছিলো। তার সঙ্গে আরও সাব ইন্সপেক্টররাও গেছিলো।’
উত্তরে ওই তরুণ বলেন, ‘একটু কম-টম করে দেখেন না হয় নাকি।’ এএসআই বলেন, ‘আচ্ছা যাও ২ হাজার কম দিও সেটা আলাদা সাবজেক্ট। এর কম আর হবে না। এখানে তো সেইরকম বড় কিছু বলা হয়নাই।’
অনেক অনুরোধ করার পর আরেক দফায় কমে টাকার অঙ্ক। এএসআই বলেন, ‘আমি ফ্রি মাইন্ডে কথা বলব? কিছু মনে নিবানা, বাংলা কথা। ঠিকাছে? কথা ঘুরলি কিন্তু উল্টা-পাল্টা হয়ে যাবে। আমি তোমাকে ভাই হিসেবে বলতেছি। তোমরা টাকা দিবা ছয়। আমি কিন্তু আমার অন্য অফিসারের কাছে বলব পাঁচ দিছে। একেবারে ছোট কইরা দিছি। বলবা যে আমার পরিচিত। এই রেফারেন্সে পাঁচ দিছি। আর কোন কথা আছে?’
‘শোনো, আমি কিন্তু বাংলা কথা বলতেছি। ছয় এর কথা আমি বলছি পাঁচ দিচ্ছো তোমরা।’— বলেন এএসআই।
এরপর ওই তরুণ বলেন, ‘পাঁচ এখন দিচ্ছি আর ছাড়ার পর আর এক দিয়ে দিব। ভাই একসাথে এখন সব নাই। পকেটে যা আছে দিয়ে দিচ্ছি।’
পরে ভিডিওতে দেখা যায়, পকেট থেকে টাকা বের করে গুনে পাঁচ হাজার টাকা দিতে গেলে ওই এএসআই বলেন, ‘আর এক মিলিয়ে আমার কাছে নিয়ে আসো।’
পরে অনেক জোরাজুরির পর সেই টাকা দিতে চাইলে ওই এএসআই বলেন, ‘না না, এখানে নিব না। টাকা পকেটে রাখো। এখানে সিসি ক্যামেরা আছে। ওই যে দেহা যায় সিসি ক্যামেরা, ওই যে। আমি কি সিসি ক্যামেরার মধ্যে টাকা নিব?’
এরপর ওই এএসআই আবারও প্রশ্ন করেন, ‘ছয় নিছো?’ উত্তরে ওই তরুণ বলেন, ‘পাঁচ নিছি আর এক একটু পর দিচ্ছি।’ এএসআই বলেন, ‘আগে নাও, আগে নাও। কথা বইলো না, এখানে বিশ্বাস নাই।’
তৎক্ষণাৎ টাকা দিতে গেলে এএসআই মোস্তফা বলেন, ‘তুমি এরকম করতেছো কেন বোকা ছেলে? সিসি ক্যামেরার সামনে টাকা নিয়ে সাধো। এদিকে আসো।’ এরপর সিসি ক্যামেরার আড়ালে নিয়ে গিয়ে টাকা পকেটে ঢুকান তিনি। পরবর্তীতে থানার ভেতরে প্রবেশ করেন।
আটক তরুণের ওই বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার বন্ধুকে রেস্টুরেন্ট থেকে থানায় ধরে নিয়ে আসা হইছে— এরকম খবর পেয়ে আমরা থানায় আসি। আসার পর আমাদের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা দাবি করেন থানার এএসআই মোস্তফা স্যার।’
‘পরে ধর্ষণ মামলা দিবে বললে আমরা মান-সম্মানের ভয়ে টাকা দিতে রাজি হই। কিন্তু এত টাকা আমাদের কাছে ছিল না। এরপর দফায় দফায় অনেক অনুরোধের পর তিনি ছয় হাজার টাকায় ছাড়তে রাজি হন। এরপর আমরা টাকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনি।’— বলেন ওই তরুণ।
সূত্র জানায়, এভাবেই টাকার বিনিময়ে সেই রেস্টুরেন্ট থেকে আটক করে আনা প্রত্যেককেই সেদিন ছেড়ে দেয় ইপিজেড থানা পুলিশ। আর এ ঘুষ বাণিজ্যের মোটা একটি অঙ্ক ঢুকে ওসির পকেটেও।
এদিকে এভাবে অনেককে আটক করে থানায় এনে আবার তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সমাজের সচেতন মহলে।
পুলিশ আটক করে থানায় নিয়ে আবার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, ‘টাকা নিয়ে কোন অপরাধীকে ছেড়ে দেয়া কাজটা হচ্ছে দুষ্ট লোকের কাজ। এখন আমাদের পুলিশ তো দুষ্টের দমন করবে, দুষ্টের পালন তো করতে পারে না। এসব কাজে ওই তরুণদের যারা নিরুৎসাহিত করার কথা তারাই এটাকে টাকা নিয়ে মাফ করে দিয়ে কঠিন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। যে পরিস্থিতিতে এসব বিষয়ে আর আইন খাটানো যাবে না। আপনাকে ছেড়ে দিলে আরেজনকে ছেড়ে দেবে না কেন?’
‘টাকা নেয়াটা গর্হিত কাজ হয়েছে। আর আমি বলব, মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়াটাও ঠিক হতো না। আরও উপরস্থ কর্তৃপক্ষের নজরে আনা উচিত ছিল বিষয়টি। পুলিশ এখানে ব্যর্থ হয়েছে। আর তাদের গার্ডিয়ানদের জানালে তারাই ব্যবস্থা নিত। আর এই ছেলে-মেয়েরাও বুঝতো এই ঘটনা টাকা দিয়ে মিমাংসা করে ফেলার জিনিস নয়। এখন আরও তাদের সাহস বেড়ে গেল।’— যোগ করেন তিনি।
অভিযুক্ত এএসআই গোলাম মোস্তফার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে অস্বীকার করে বলেন, ‘এটা আমি না। এটা হয়তো অন্য কেউ হবে। আমি কোন রেস্টুরেন্টে অভিযানে যাইনি। আপনি ভালভাবে দেখেন। যদি এরকম কিছুতে আমি থাকি তাইলে আপনি যা বলেন আমি তাই করব। কিন্তু আমি এরকম কোন কিছুতে জড়াইনি।’ এরপর ওসি স্যার ফোন দিয়েছে বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
কিছুক্ষণ পর এ প্রতিবেদকের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে তিনি ফোন করে রেস্টুরেন্টে অভিযানে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। হোয়াটসঅ্যাপে ১৩ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের ওই কথোপকথনের অডিও কল রেকর্ড এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।
তিনি এসময় বলেন, ‘শুনেন, যে জায়গায় আমার ওসি স্যার যাবেন, আমার সিনিয়র অফিসাররা যাবেন সে জায়গায় গেলে আমার তাদের সঙ্গে যাওয়া হয়। যে জায়গায় আমার সিনিয়ররা থাকবে সেখানে তো আমার কোন কথা বলার সুযোগ নেই। তারা যদি বলে অমুককে এই করো এই নাও। এখন সেখানে কি জন্যে কি করতেছে তাদের কাছে তো প্রশ্নও রাখা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘আপনি যেহেতু শুনছেন আপনি তো জানেন এখানে আমার ওসি স্যার ছিলেন। এছাড়া সম্ভবত আরও ৪-৫ জন সাব-ইন্সপেক্টররাও ছিলেন। সে জায়গায় আসলেতো কথা বলারও সুযোগ নেই আমার।’
এরপর তিনি নিজেকে সৎ অফিসার দাবি করে বলেন, ‘আপনি যদি এমনি ইপিজেড এলাকায় আমার ব্যাপারে খোঁজ নেন, তাহলে দেখা যাবে আমি চাকরি করি সততার সঙ্গে খুব। বাড়ি-টারিও খুব কম যাই আমি। আর যে হোটেলের কথা বলা হচ্ছে বন্দরটিলার, ওটা আসলে বন্দরটিলাও না। আসলে আমি একবারই গেছি স্যারদের সঙ্গে। এখন যদি কেউ বলে ওইখানে নিয়ে চলো, তাহলেও কিন্তু আমার পক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না ওই হোটেলে। কারণ ওই জায়গায় একটা চিপা গলির ভেতরে ঢুকে গেছিল। আর ওই জায়গায় যে রেস্টুরেন্ট আছে সেটাও আমার জানা ছিল না।’
ভিডিও ফুটেজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখেন আমিতো আমার সিনিয়র অফিসাররা নিয়ে গেছে তাদের সঙ্গে আমি গেছি। যে জায়গায় ওসি স্যার প্রেজেন্ট সেখানে তো আর কোন কথা বলার সুযোগ নাই। আর আপনি যেটা বলছেন সেটা হয়তো লোকজন এসে বলছে পরিচিত লোকের মাধ্যমে ছাড়াই দেয়ার জন্য। তারা ডাকছে, তাদের সঙ্গে হয়তো কথা বলছি। তারপরও কথা হচ্ছে, যেহেতু আমরা পাবলিক ফাংশনে চলাফেরা করি আপনারাও সংবাদ সংগ্রহ করেন, রাস্তাঘাটে কোন জায়গায় যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন ভুল ত্রুটি হয় আপনারা যদি আমাদের একটু পাশে থেকে সহযোগিতা না করেন তাইলে কারা করবে?’
‘আর ডিউটির ক্ষেত্রে ওসি স্যার নিজে যখন প্রেজেন্ট, তিনি নিয়ে গেছেন আর কি। সামনে যত অফিসার পাইছেন সবাইকে নিয়ে গেছেন। আর সেই সঙ্গে আমারেই পাইছে, নিয়ে গেছেন। আর সাথে যদি আরও সিনিয়ররা থাকে তাইলে তো আমার চুপচাপ থাকা লাগে, যেভাবে ডিলটা বলবে সেভাবে করতে হবে।’
এরপর তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে একসঙ্গে বসে চা-নাশতা খাবার দাওয়াত দিয়ে নিউজ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘যদি পারেন আপনার বসের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টা কিভাবে কি করা যায় একটু দেখেবেন। দরকার হলে আমি আসলাম, নাইলে আপনারা আইসেন এদিকে।’
এ ঘটনায় সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কবিরুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও মুঠোফোনে সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের বন্দর জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) আবুল কালাম শাহিদ এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘কাউকে আটক করে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি সমীচীন নয়। অভিযোগ পেলে এ বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’













