সুমন পল্লব »
চট্টগ্রামের হাটহাজারী পৌরসভায় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সন্দ্বীপ পাড়া। পাড়ার শুধু দু-একজন নারী স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছেন। এদের একজন জেসমিন আক্তার। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন—লেখাপড়া করে একদিন অনেক বড় মানুষ হবেন। কিন্তু অল্প বয়সেই পারিবারিক চাপ ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়।
স্বামীর সংসারে এসেও সুখ পায়নি সে, ঘিরে ধরে অভাব। স্বামী মো. মজিবুল প্রতিদিন পাহাড়ের বাগানে গিয়ে লাকড়ি কুড়িয়ে এনে বাজারে বিক্রি করে যা পেত তা দিয়ে কোন মতে সংসার চালাতো। তবুও অভাব-অনটন লেগেই থাকতো। এসব দেখে হতাশ না হয়ে বরং ঘুরে দাঁড়িয়েছেন জেছমিন। বাঁশ ও বেত দিয়ে নিজের হাতের তৈরী করতে শুরু করেন বিভিন্ন ধরনের মুরগীর খাঁচা, ডালা, মোড়া, কুলা এবং মৌসুম উপযোগী হরেক রকমের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। পাশাপাশি কাজ শিখিয়ে উপার্জনের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন নিজ গ্রামের ৪ জন হতদরিদ্র নারীকে।
ফলে জেসমিনের পরিবারকে এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না। তাঁকে শুনতে হয় না শশুর বাড়ির গালমন্দ। কারণ এখন তিনিই অর্থের যোগান দিচ্ছেন এবং দারিদ্রকে জয় করেছেন। তাদের সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা, স্বাচ্ছন্দ।
জেসমিন আক্তারের শৈশবকাল থেকেই হাতের কারুকার্য তৈরী করার প্রতি শখ ছিল। এতে তাঁকে তাকে সাহায্য করেছিল তাঁর বাবা। ছোটবেলা থেকেই জেসমিনের ইচ্ছে ছিলো নিজ পায়ে দাঁড়ানোর। সেই ইচ্ছে স্বামীর অভারী সংসারে এসেও তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। চিন্তা করতেন কিভাবে দু’পয়সা বাড়তি আয় করা যায়। তবে কিছুই করার আগেই সংসারে কোল জুড়ে আসে পর পর ৩টি ছেলে ও ১টি মেয়ে সন্তান। পরে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর পাশাপাশি নতুন আরেকটি স্বপ্ন দেখতেন, কীভাবে সন্তানদের করা যায়।
জেসমিন আক্তার জানান, ১৯৯১ সালের ঘূর্নিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায় নিজ এলাকা। সেই ঘূর্নিঝড়ের থাবা তছনছ করে দেয় জেসমিন আক্তারদের সামান্য মাথা গুজবার ঠাঁইটুকুও। এরপর তার বাবা ও আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শক্রমে স্থানীয় বাজার থেকে বাঁশ ও বেত কিনে এনে বাড়িতে বসেই শুরু করেন বসার মোড়া তৈরীর কাজ। প্রথমে সপ্তাহে ২দিন স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করার সুযোগ করে দেন তার স্বামী। বিক্রিকৃত টাকা হাতে পেয়ে তার মধ্যে অনুপ্রেরণা ও সাহস যোগায়। শুরু হয় এগিয়ে চলা। নতুন নতুন স্বপ্ন উঁকি দেয় তার মনে।
শুরুতে এ কাজে প্রথমে তার স্বামী সাড়া দেয়নি। এরই ফাঁকে হাটহাজারী এডিপি, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ তাকে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সাথে সংযোগ স্থাপন করে দেয় যাতে আয়বৃদ্ধিমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা পেতে পারে।
জেসমিন আক্তার জানান, বসার জন্য মোড়া ও খাঁচা সামগ্রী তৈরিতে ৩০-৪০ টাকা খরচ করতে হয়, কিন্তু বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২২০ টাকায়। বর্তমানে আয় হয় বেশ ভালই।
তিনি বলেন, উক্ত উপকরণ সামগ্রী বিক্রিত টাকা যখন হাতে পাই তখনই খুব আনন্দ লাগে। সংসারের অভাব যে কিভাবে পালালো তার কোন টেরই পাইনি। এই পথটি যিনি দেখিয়েছিলেন তিনি আমার বাবা। সেজন্য বাবাকে সবসময় শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
সন্দ্বীপ পাড়া গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ওবায়েদুল্লাহ বলেন, জেসমিন আক্তার এর মধ্যে দূর দৃষ্টি রয়েছে বিধায় তার সফলতা আসছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে ২ জন ছেলেকে বিদেশে চাকুরীর জন্য পাঠিয়েছে। আর ছোট ছেলে আরমান (২২) বর্তমানে ডিপ্লোমা কোর্সে পাওয়ার টেকনোলজিতে ৭ম সেমিষ্টারে অধ্যয়নরত। তিনি নিজেই স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছে অন্যদেরকেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করেছেন।
জেসমিন আক্তার স্বপ্ন দেখেন, এক সময়ে তাঁর গ্রামে হতদরিদ্র নামক শব্দটি মুছে যাবে।
বাংলাধারা/এফএস/এআর













