সম্পাদকীয় »
মা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি সকলের কাছেই প্রিয়। আমরা বাঙালি জাতি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। যার জন্য রচিত হয়েছে অভূতপূর্ব ইতিহাস। আর বাংলা ভাষার জয় পতাকারূপে বাঙালির চেতনার আকাশে দীপ্ত অহঙ্কারে উড়ছে একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির মাতৃভাষা দিবস।
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের ১৯১টি দেশ আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে আত্ম উত্সর্গকারীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে উদযাপন করছে মাতৃভাষা দিবস। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর ৩১তম সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত “মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা” ১৮৮টি দেশের প্রতিনিধির সমর্থনে গৃহীত হয়। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাঙালির কাছেই স্মরণীয় নয়, সমস্ত বিশ্বে এদিনটি পালিত হয় যথাযথ মর্যাদাসহকারে। উল্লেখ্য যে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করে কানাডাপ্রবাসী ১০ জনের একটি দল।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতি মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকার আদায়ে প্রাণ দিয়েছে। রচিত হয়েছে অভূতপূর্ব ইতিহাস। বুকের রক্ত দিয়ে সালাম, সফিক, বরকত, জব্বার, রফিক যে ইতিহাস রচনা করেছেন, সেটিই হয়ে উঠেছে বাঙালির অধিকার আদায়ের, মাথা নত না করার চির প্রেরণা।
তাই একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু একটি দিন নয়, বাঙালির আবেগ, ভালোবাসা, আত্মপরিচয়ের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া এক প্রেরণার উৎস। আজ সেই মহান শহীদ দিবস। শহীদ মিনারে অমর সেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে আজ সবাই। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানুষের ঢল। পুষ্পে পুষ্পে ভরে যাবে শহীদ মিনার। আমরা শ্রদ্ধাবনতচিত্তে ভাষা আন্দোলনের জানা-অজানা সব শহীদকে স্মরণ করি।
মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, “আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিশ এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিশ যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হলো। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম।” (পৃষ্ঠা-৯১, ৯২)। ’৪৮-এর ১১ মার্চ অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বাংলার ছাত্রসমাজ প্রথম প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। সেদিন যারা মাতৃভাষার দাবিতে রাজপথে সংগ্রাম করে কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং জনাব শামসুল হক ছিলেন তাদের অন্যতম। মার্চের ১১ থেকে ১৫- এই পাঁচ দিন কারারুদ্ধ ছিলেন নেতৃবৃন্দ। পাঁচ দিনের কারাজীবনের স্মৃতিতর্পণ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল ১০টায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর ৪টায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,’ ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই,’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’-নানা ধরনের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, হক সাহেব ওই দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না। হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব’।” (পৃষ্ঠা-৯৩, ৯৪)। বাংলার মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস্য আত্মপ্রত্যয় ছিল! তখন কে জানতো যে, ’৪৮-এর এই ১১ মার্চের পথ ধরেই ’৫২, ’৬৯ এবং ’৭১-এর একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে! কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জানতেন! কারণ তিনি দূরদর্শী নেতা ছিলেন- লক্ষ্য স্থির করে কর্মসূচি নির্ধারণ করতেন। যেদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেদিনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি; একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। আর তাই তিনি ধাপে ধাপে সমগ্র জাতিকে প্রস্তুত করেছেন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য।
শিক্ষা, পাঠ্যপুস্তক ও সংবাদপত্রের মতো আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলোতে বাংলার ব্যবহারের যা অবস্থা তা থেকে অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলোতে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঢাকা শহরের দোকানপাটে বাংলাতেই প্রায় সব নামফলক (সাইনবোর্ড) টাঙানো থাকত। সময়ের সঙ্গে সে ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে অনেক; বাংলাকে সরিয়ে এসেছে ইংরেজি, বিশেষ করে শহরের অভিজাত অঞ্চলগুলোতে। আর বাংলায় লিখলেও অনেকগুলোতে দেখা যায় ভুলের ছড়াছড়ি, যা কখনো কখনো আপত্তিকর পর্যায়েও চলে যেতে পারে।
দেশের মানুষের মুখের ভাষার জন্য আগে পিছে না ভেবে যাদের আন্দোলন-আত্মত্যাগে বাংলা ভাষার অর্জন, তাদের প্রতি রইল শ্রদ্ধা। তাদের ত্যাগ তখনই স্বার্থক হবে যখন দেশের সর্বস্তরে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যাবে প্রাণের ভাষা বাংলা। আমাদের আশাবাদ, স্ব স্ব ক্ষেত্রে এ বিষয়ে সবাই সচেষ্ট হবেন। মহান একুশেতে ভাষা শহীদসহ সকল ভাষা সংগ্রামীর প্রতি আবারও আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
বাংলাধারা/এফএস/এআর













