জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার»
কক্সবাজার আদালত পাড়া থেকে এক অসুস্থ তরুনীকে তুলে নিয়ে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণ’ মামলার আসামী ও পুলিশের নাম ভাঙিয়ে মাদক ব্যবসা, দখলবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত সেই রাসেল উদ্দিনকে অবশেষে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) বিকেলে তার পক্ষে করা জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-২ ও শিশু আদালত-২, কক্সবাজারের বিচারক মো. মশিউর রহমান খান এই আদেশ দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান রেজা।
নারী আদালত-২ এর স্পেশাল পিপি রেজা বলেন, এক অসুস্থ নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার পরই হাইকোর্ট থেকে রাসেল চার সপ্তাহের জামিন নেন। হাইকোর্টের নির্দেশে নিম্ন আদালতে মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে স্থায়ী জামিনের জন্য রাসেলের আইনজীবী সাহাব উদ্দীন নিন্ম আদালতে জামিন শুনানি করেন৷ রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী হিসেবে বিরোধিতা করা হয়। শুনানি শেষে বিচারক জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আদেশের পরপরই বিকেলে রাসেলকে কারাগারে পাঠানো হয়।
উল্লেখ্য, কক্সবাজার আদালত পাড়া থেকে অস্ত্র ঠেকিয়ে তুলে নিয়ে একটি বাড়িতে আটকে রেখে অসুস্থ তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ তুলে ভুক্তভোগী নারী। এ ঘটনায় গত ১৪ মার্চ রাতে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় চারজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন ওই তরুণী।
আসামীরা হলেন, কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের মধ্যম পোকখালীর রমজান আলী মেম্বারের ছেলে বর্তমানে ঈদগাঁওর ফকিরাবাজার এলাকায় বসবাসকারী ফিরোজ আহমদ (৪৭), পোকখালীর সিকদারপাড়ার লোদা মিয়ার দুই ছেলে রাসেল উদ্দিন (৩৮) ও নুরুল ইসলাম এবং ঈদগাঁও ইসলামপুর ইউনিয়নের ফকিরা বাজার এলাকার মৃত আব্দুল গণির ছেলে মো. শরীফ। তাদের সহযোগী হিসেবে আরও চার-পাঁচজন এ ঘটনায় অংশ নেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ঈদগাঁওর ঢালার দুয়ার এলাকার ভুক্তভোগী ওই নারীকে ফিরোজ আহমদ ও মো. শরীফ বিভিন্ন সময় উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন। তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি দেয়া হয়। ১৪ মার্চ দুপুর ২টার দিকে কক্সবাজার আদালত পাড়ায় জনৈক অ্যাডভোকেটের চেম্বার থেকে বের আসার সময় তারা তরুণীকে ঘিরে ফেলেন। এক পর্যায়ে ফিরোজ ও শরীফ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বাধা দিলে অজ্ঞাতপরিচয় আরও কয়েকজন এসে তরুণীকে হাত-পা ও মুখ চেপে ধরে একটি নোহা গাড়িতে তুলেন। এ সময় ফিরোজ মেয়েটির গলায় থাকা ১২ আনা ওজনের স্বর্ণের চেইন এবং সঙ্গে থাকা টাকা নিয়ে নেন।
পথচারীরা তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে অভিযুক্তরা গাড়ি নিয়ে কক্সবাজার ল্যাবরেটরি স্কুল সংলগ্ন (বাহারছড়া) ফিরোজের আত্মীয় ফজল কাদেরের টিনশেড বাসায় নিয়ে একটি রুমে আটকে রাখেন। এরপর ফিরোজ ও শরীফ তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যার ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করেন। পরে একইভাবে নুরুল ইসলামও তাকে ধর্ষণের পর তরুণীর মোবাইল ফোন ও টাকা নিয়ে চলে যান।
কিছু সময়পর রাসেল উদ্দিন রুমে এসে নিজেকে পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বিষয়টি কাউকে জানালে এবং বেশি বাড়াবাড়ি করলে মানবপাচার মামলায় চালান করে দিবে বলে হুমকি দেন। একপর্যায়ে রাসেল উদ্দিনও তাকে ধর্ষণ করেন। এতে তরুণীর গোপনাঙ্গ দিয়ে রক্তপাত শুরু হলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর রাসেল ও শরীফ তাকে টানা হেছড়া করে গেটের বাইরে রাস্তায় রেখে আসেন। এমন দৃশ্য দেখে রাস্তায় থাকা এক ব্যক্তি তাৎক্ষণিক জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ কল দিলে অভিযুক্তরা পালিয়ে যান। পরে পুলিশ এসে তরুণীকে উদ্ধার করে। পরবর্তীতে র্যাব অভিযান চালিয়ে বাকীদের বিপুল অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন।

এদিকে, রাসেলের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে মিলেছে পিলে চমকানো তথ্য। ডিসেম্বরে স্বামী-সন্তান জিম্মি করে কক্সবাজারে গৃহবধূকে তুলে নিয়ে ধর্ষণকাণ্ডের মূলহোতা আশিক, মেহেদী হাসান বাবুদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষক হলেন এই রাসেল উদ্দিন। রাসেলের অধীনে পর্যটন শহরে অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী, পর্যটকদের ছিনতাই, ধর্ষণ, ব্ল্যাকমেইল, চাঁদা ও দখলবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। পুলিশের কিছু কর্মকর্তার সাথে সখ্যতার বদৌলতে গড়ে তুলেছেন ‘ভুয়া পুলিশ’ বাহিনীও। তারা সুযোগ পেলেই রাতে রাসেল নিয়ন্ত্রিত কয়েটি হোটেলে পর্যটকদের জিম্মি করে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ আছে, কক্সবাজারের বেশিরভাগ পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে চলে-বলে কৌশলে সম্পর্ক করে রাসেল গ্যাং আইনের আওতায় আসা দূরে থাক, উল্টো বিভিন্ন সময় এসপির ভাব নিয়ে পুলিশের গাড়িতে চক্কর দিয়ে নিজের ক্ষমতা জানান দিতেন। পুলিশের গাড়িতে চক্করে তার সঙ্গী হন কক্সবাজারে চিহ্নিত ইয়াবা কারবারিরাও। পুলিশের গাড়িতে চক্কর দেয়ার বেশ কয়েকটি ছবি প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। শুধু তাই নয়, পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে নিয়মিত একান্ত বৈঠক, জন্মদিন পালন কিংবা জুম মিটিংয়ের ছবিও প্রকাশ পেয়েছে। এসব ছবি রাসেলের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট হওয়া থাকলেও ধর্ষণকান্ডে অভিযুক্ত হবার পর তার মুচে দিয়েছেন ঈদগাঁওর পোকখালী সিকদার পাড়ার লোদা মিয়ার ছেলে রাসেল উদ্দিন।
সূত্র জানায়, নানা অপকর্মে জড়িয়ে স্থানীয়দের তোপের মুখে প্রায় ১০ বছর আগে এলাকা ছেড়ে কক্সবাজারে গিয়ে সুগন্ধা পয়েন্টে এপার্টমেন্ট হোটেল-আলফা ওয়েবে পিয়নের চাকরি নেন রাসেল। পরবর্তী ওই হোটেলের ম্যানেজার হন রাসেল। হোটেল-আলফা-ওয়েবের কয়েকজন ফ্ল্যাটের মালিক অভিযোগ করে বলেন, রাসেল ম্যানেজার হওয়ার পর সেখানে ৮০১নং ফ্ল্যাটে প্রতি রাতে মাদক ও তরুণীদের নিয়ে পার্টির আয়োজন করা হয়। সে আসরে কতিপয় পুলিশ অফিসার ও কক্সবাজারের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা আসতেন।
এভাবে পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের বাগে এনে তাদের সহযোগিতায় গত কয়েক বছর আগে হোটেলটির বেশিরভাগ ফ্ল্যাট দখল করে নেন রাসেল। কয়েকজন মালিকও তাদের প্রতিনিধিদের পুলিশ দিয়ে নির্যাতনের পর ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে হোটেল ও দেশ ছাড়া করেছেন বলে দাবি করেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অ্যাপার্টমেন্টের একজন মালিক জানান, ৮০১নং ফ্ল্যাটে একটি কক্ষে নিয়মিত কয়েকজন সুন্দরী রাখা হয়। তারা পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের সেবার পাশাপাশি সেখানে নিয়মিত পর্যটকদের মাদক বিক্রি এবং সেবন করান। পরে মোটা অংকের টাকা দিতে না চাইলে পুলিশ পরিচয়ে কোমরে পিস্তল নিয়ে সেখানে হাজির হতেন রাসেল ও আলোচিত ধর্ষণকাণ্ডের মূলহোতা আশিকসহ আরও কয়েকজন। এরপর নারী ও ইয়াবা দিয়ে পর্যটকের ছবি তোলা হয়। ৮০১ নম্বরের আরেকটি কক্ষে নিয়ে টর্চার করা হয়। মোটা অঙ্কের টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত সেখানে বন্দি করে রাখা হতো। কয়েকজন পুলিশ অফিসারও তাদের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ তার।
রাসেলের বর্তমান বসতি শহরের বাহারছড়ার স্থানীয়দের দাবি, রাসেল দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে ইয়াবার ব্যবসা করছেন। অনেক তরুণকে দিয়েও ইয়াবা ব্যবসা করান। এ বিষয়ে থানায় মৌখিকভাবে অভিযোগ দিয়ে উল্টো পুলিশের হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে দাবি অনেকের।
স্থানীয়রা বলছে, রাসেল বলে বেড়ান পুলিশ কর্তৃক উদ্ধার হওয়া ইয়াবা বিক্রির দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়েছে। তাই এসব ইয়াবা বিক্রি করলে পুলিশ ধরবে না। নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় কয়েকজন জানান, সন্ত্রাসী ও আলোচিত ধর্ষণ মামলার আসামি আশিক শহরের বেশিরভাগ সন্ত্রাসী তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দখলবাজি পাশাপাশি, তার অধীনে চলে চাঁদাবাজি ছিনতাইসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে তার সুসম্পর্কের কারণে তাদের কেউ গ্রেফতার হন না। এর ফলে পর্যটন নগরীতে প্রতিদিন ছিনতাই ও চাঁদাবাজি বেড়েই চলছে বলে দাবি তাদের।
স্থানীয় সূত্র ও মাঠ পর্যায়ে কাজ করা একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক সদস্য জানান, কক্সবাজার শহরের যেকোন সন্ত্রাসী গ্রেফতার হলে রাসেল তাকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হলে তার নিজের টাকা খরচ করে জেল থেকে জামিনে বের করেন। এরপর তাকে তার দলে ভিড়িয়ে দখল ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করান।
সেই রাসেল কারান্তরিণ হবার খবর প্রচার হওয়ায় ভুক্তভোগী অনেককে স্বস্তি প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আগে রাসেলের সাথে কার সম্পর্ক ছিলো আমার জানা নেই। কিন্তু আমরা দায়িত্বে আসার পর কোন পুলিশের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো না। আমরা অপরাধীকে অপরাধ দিয়ে বিচার করি।













