২৫ অক্টোবর ২০২৫

কক্সবাজারে অপরিকল্পিত ভ্রমণে ভোগান্তিতে পর্যটকরা

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

‘করোনার কারণে সর্বত্র ভয় কাজ করছে। এজন্য মনে করেছিলাম বেড়াতে কম লোকজনই বের হবেন। কিন্তু আমার ধারণা শুধু ভুলই প্রমাণ হয়নি, আমাদের ভ্রমণটাই চরম ভোগান্তির উদহারণ হয়েছে। আমাদের মতো অপরিকল্পি ভ্রমণে এসে সৈকত তীর, বালিয়াড়ি, রাস্তার ধারে পার্ক করা গাড়িতে বা ফুটপাতে এবং দোকানের সামনে বসে রাত পার করতে হয়েছে অসংখ্য পর্যটককে। সাথে শৌচ নিয়েও দুর্ভোগ পার করেছি এভাবে রাত্রিযাপন করা ভ্রমণকারিরা।’

আগাম রুম বুকিং না দিয়ে বিজয় দিবস ও সপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে তিনদিনের জন্য পরিবার, স্বজন মিলিয়ে ২২ জনের টিম নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে এসে পোহানো ভোগান্তি এভাবেই বর্ণনা করছিলেন ঢাকার কেরানিগঞ্জের মোর্তোজা মোরশেদ।

তারই মতো ভোগান্তির কথা জানান সিলেটের সুনামগঞ্জ থেকে আসা প্রসেনজিত দাশ ও কিশোরগঞ্জ সদরের শফিকুল ইসলাম। তারা বলেন, পরিচিত কয়েকজন বলছিলেন- আগে হোটেল বুকিং দিতে। তখন মনে করেছিলাম করোনা ও তার নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রণের ভয়ে হয়তো লোকজন তেমন আসবেনা কক্সবাজার। তাই ওয়াকিং গেস্ট হিসেবে রুম পাওয়া যাবে। কিন্তু পরিবার নিয়ে এসে রুম না পেয়ে যে ভোগান্তি পেয়েছি তা আজীবন মনে থাকবে।

শুধু তারা নয়, বিজয় দিবসের এ ছুটিতে এভাবে অপরিকল্পিত ভাবে বেড়াতে এসে ভোগান্তি পেয়েছেন হাজারো পর্যটক। এভাবে আসা অনেক পর্যটক হোটেলে ঠাঁই না পেয়ে রাত্রিযাপন করেছেন যাত্রীবাহী বাস, সৈকতের কিটকট চেয়ারে (বিনোদন ছাতা), কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোনের ফুটপাত এবং দোকানের বাইরের বারান্দায়। অনেকে সৈকতের খোলা আকাশের নিচেও রাত কাটিয়েছে। কেউ কেউ স্থানীয়দের বাসা-বাড়িতে অবস্থান নিয়েও রাত্রীযাপন করেছে বলে জানা গেছে। বিকল্প স্থানে থাকতে গিয়ে এসব পর্যটকদের মোটা টাকা গুনতে হয়েছে। সবচাইতে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পরিবারসহ ভ্রমণ করতে আসা লোকজনদের। পরিবার পরিজন নিয়ে স্থানীয়দের বাসা-বাড়িতে থাকতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হন এসব পর্যটক। বাস-ফুটপাতে রাত কাটালেও শৌচাগার না পেয়ে দুর্ভোগে পড়েন পর্যটকরা। শৌচাগার নিয়ে নারীই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পেয়েছেন। গণশৌচাগার না পেয়ে অনেকে খোলা জায়গায়, রাস্তার ধারে মলমূত্র ত্যাগ করেছে। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।ভোগান্তি ও হয়রানির মুখে অনেক পর্যটক ভ্রমণসূচি সংক্ষিপ্ত করে ফিরে গেছেন বলেও খবরও পাওয়া গেছে।

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারে এক রাতে এক লাখ বিশ হাজার পর্যটকের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু টানা ৩ দিনের ছুটিকে কেন্দ্র প্রথমদিনই দেড়-দু’লাখ পর্যটক কক্সবাজার চলে আসেন। এদের একচতুরাংশ সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, ইনানী ও আশপাশের পর্যটন এলাকায় গিয়ে উঠলেও কক্সবাজার পর্যটন জোন কলাতলী ও শহর কেন্দ্রিক ছিলেন দেড় লাখের মতো। ফলে, অনেকে রুম না পেয়ে ভোগান্তি পেয়েছেন।

সূত্র মতে, পর্যটন মৌসুম চলমান, আবার তিনদিনের ছুটি সব মিলিয়ে বিপুলসংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটবে এটা আঁচ করতে পেরে এক শ্রেণির দালাল চক্র আগে থেকে নিজেদের নামে হোটেল রুম বুকিং করে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করে। তারাই অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেয়। এক হাজার টাকার রুম ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা, দুই হাজার টাকার রুম ৭-৮ হাজার টাকা, ৩ হাজার টাকার ৯-১০ হাজার টাকা বা তার চেয়েও অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। পর্যটকরাও অনন্যোপায় হয়ে এ বাড়তি টাকা দিতে বাদ্য হন। একই ভাবে খাবার হোটেলগুলোতেও অরাজকতা বিরাজ করছে। প্রতিটি খাবার মেন্যুর মূল্য রাতারাতি ৪-৫ গুন বাড়ানো হয়েছে। রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের ভাবসাব অনেকটা এমন, ‘পোষালে বসেন, না পোষালে হাটেন’। এককথায় সর্বত্র চরম অব্যবস্থাপনায় এক ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

অনেকে দুর্ভোগ পেলেও প্রশাসনের কাছে না যাওয়ায় ব্যবস্থা নেয়া যায়নি উল্লেখ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মুরাদ ইসলাম বলেন, অভিযোগ পেয়ে সী-পার্ল-১ ও ২ নামে ফ্ল্যাট আবাসনে শুক্রবার অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় অতিরিক্ত নেয়া টাকা ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা রা হয়েছে। পাশাপাশি এ ফ্ল্যাট পরিচালকদের ৫ হাজার টাকা এবং অপর আবাসন প্রতিষ্টান হোটেল ওপেলাকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

হোটেল সী নাইট’র ব্যবস্থাপক শফিক ফরাজী বলেন, আমাদের পর্যটকরা এখনো অপরিকল্পিত ভ্রমণে বের হন। ডিজিটাল সময় হিসেবে সব হোটেল-গেস্ট হাউজের যোগাযোগ নাম্বার ওয়েব সাইট বা ফেসবুক পেইজে দেয়া আছে। সেখানে যোগাযোগ করে সরাসরি বুকিং দিলে ঠকতো কম। এ ছাড়াও সবাই শুধু বন্ধের দিনগুলোতে আসার জন্য মুখিয়ে থাকেন। যার ফলে চাপের কারণে থাকা-খাওয়া সবখানেই বাড়তি টাকা গুনতে বাধ্য হন। সপ্তাহিক খোলার দিনগুলোতে বেড়াতে আসা বুদ্ধিমান পর্যটকের কাজ।

ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি মো. জিল্লুর রহমান জানান, ধারণা চেয়ে পর্যটকের সংখ্যা বেশি এসেছে কক্সবাজারে। একসঙ্গে অসংখ্য পর্যটক সমাগম ঘটায় সীমিত জনবল দিয়ে পর্যাপ্ত সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরপরও সবার সমন্বিত প্রচেষ্ঠায় পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। অনাকাঙ্খিত ঘটনা রোধে সচেষ্ট রয়েছি আমরা।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, এক সাথে বিপুল পর্যটক সমাগম হওয়ায় চাপ বেড়েছে। এরপরও যারা নিয়ম না মেনে পর্যটক ঠকাচ্ছে বলে প্রমাণ মিলছে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এত হোটেল-রেস্তোরায় খুঁটিয়ে নজর রাখা কষ্টসাধ্য। তাই কেউ প্রতারণার শিকার হয়েছেন বুঝলেই সৈকত এলাকার জেলা প্রশাসনের তথ্য সেলে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানান ডিসি।

আরও পড়ুন