সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
কক্সবাজারে প্রশাসনের হিসেবে গেল একমাসে ১৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ হিসেবের পর আরো দুটি ধর্ষণ দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা ও উদ্বেগের জন্ম দিলেও তা এই হিসেবে আসেনি। কিন্তু এ দুটি ধর্ষণ বিষয়ে মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। ফলে এ ধর্ষণসহ গতকাল পর্যন্ত (২৮ ডিসেম্বর) ২০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজারে।
বুধবার (২২ ডিসেম্বর) কক্সবাজার শহরে সংঘবদ্ধ দুর্বৃেত্তর হাতে ধর্ষণের শিকার হন কক্সবাজারে বেড়াতে আসা এক গৃহবধূ। ১৩ ডিসেম্বর শহরের নুনিয়ারছড়া এলাকা থেকে তুলে নিয়ে স্কুল ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে ১৮ ডিসেম্বর কক্সবাজার মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছেন স্কুল ছাত্রীর পিতা। এর আগে ৭ ডিসেম্বর ঝিলংজার মুহুরি পাড়া এলাকায় ধর্ষণের শিকার হন তৃতীয় শ্রেণীর মাদ্রাসার ছাত্রী। প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল।
অভিযোগের পক্ষপাতমূলক তদন্ত, মামলা দায়েরে অনিহা, বিচারহীনতা, আর বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ধর্ষণ প্রবণতার মূল কারণ বলে দাবি করেছেন তারা। আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং দ্রুত সময়ে বিচার কার্যকর করা গেল ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে বলেও মনে করেন তারা।
এদিকে হোটেলে নারী ধর্ষণের ঘটনাকে পর্যটক বলে ফলাও করে প্রকাশ করার পর পর্যটন শিল্পে বিরুপ প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা।
চেম্বার অব কমার্স’র সভাপতি বলেন, ‘অনাকাংখিত এ ঘটনার ভেতরে না ঢুকে পর্যটক নারী বলে প্রচার করায় চরমভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পর্যটন শিল্পে। অনেক পর্যটক তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন অনেকে। আমাদের সুনাম রক্ষা করতে জেলা প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে পর্যটন জোনে নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর প্রয়োজন।’ একই সাথে পর্যটন শিল্পে যেন নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেদিকটি মাথায় রেখে পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতি আহবান জানান তিনি।
কক্সবাজার জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, ১৬ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর এক মাসে ১৮ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যেখানে নভেম্বরের শেষ পক্ষকালে ৮টি এবং ডিসেম্বরের প্রথম পক্ষকালে গিয়ে তা হয়েছে ১০টি। একই সময়ে নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৬টি।
কিন্তু কাগজে কলমে ১৮টি ধর্ষণের ঘটনা দেখা গেলেও বাস্তবে এ সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, অনেক ভুক্তভোগী বিচার পাওয়া নিয়ে শংকিত থাকেন। আবার অনেকে মামলার বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে আইনের আশ্রয় নিতে চান না। ফলে তালিকার বাইরে রয়ে যায় ধর্ষণের অনেক ঘটনা।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের দায়িত্বশীল একটি সূত্রে দেয়া তথ্য মতে, গেল এক মাসে ধর্ষণের আলামত নিয়ে ১৯ জন হাসপাতালে সেবা নিতে আসেন। সম্প্রতি উপজেলা পর্যায়ে ধর্ষণের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করায় অনেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। তাই সঠিক তালিকা হাসপাতালে নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডিজিটাল সময়ে ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি পিতামাতার উদাসিনতা, মামলা করতে গিয়ে ভোগান্তি, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, ভুক্তভোগীদের মামলা দায়ের করতে অনিহা এবং নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়ার কারণে ধর্ষণ ব্যাধি লেগে আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্বশীল আচরণ এবং দ্রুত বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে করা আবশ্যক।
কক্সবাজার পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও নারী কাউন্সিলর শাহেনা আকতার পাখি বলেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘ সূত্রিতা এবং মামলা তদন্তে পক্ষপাতের কারণে অভিযুক্তরা শাস্তির আওতায় কম আসেন। ফলে সুযোগ পেলেই অপরাধে জড়াচ্ছে বিকৃত মানসিকতার মানুষগুলো।’ দেশের প্রচলিত আইনের যথাযত প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘জাগো নারী’র নির্বাহী পরিচালক শিউলি শর্মা বলেন, ‘বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের অপব্যবহার হচ্ছে। ফলে কিশোর বয়সের ছেলে-মেয়েরা পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি ধাবিত হয়ে ভাল কিছু গ্রহণ না করলেও মন্দকে গ্রহণ করছে। যার প্রভাব পড়ছে তাদের চিন্তা ও চেতনায়। এ জন্য পিতা-মাতার উদাসিনতাও অনেকটাই দায়ি।’
তিনি বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম নারীর প্রতি এখনো পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পবির্তন হয়নি। ফলে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়।’ এ অবস্থায় সচেতনতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি।
লিগ্যাল এইড কক্সবাজারের প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট বাপ্পী শর্মা বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ও ৯(২) ধারায় ধর্ষনের শাস্তির বিধান যাবজ্জীবন। আর মৃত্যু ঘটলে মৃত্যুদন্ডের ২০(৩) ধারায় বিচারের জন্য মামলা প্রাপ্তির ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার কার্য সমাপ্ত করার কথা। কিন্তু বাস্তবে সঠিক সময়ে তদন্ত শেষ হয় না। এছাড়া আদালতে উপযুক্ত সাক্ষি ও প্রমাণের অভাবে অনেক অপরাধী মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে যান। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার একমাত্র উপায় হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন।’
এদিকে, হোটেলে নারী ধর্ষণের খবর প্রকাশ পাবার পর নড়েচড়ে বসেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। গেল শুক্রবার সন্ধ্যায় এক সভার আয়োজন করে পর্যটকদের নিরাপত্তায় ৭ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘আমরা অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখি। অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর পর জামিনে বের হয়ে আবার অপরাধ করে। শুধু শঙ্খলাবাহিনীর প্রচেষ্টায় সমাজের অপরাধ কমানো অসম্ভব। পরিবার ও সমাজ যদি একতাবদ্ধ হয়ে সন্তানদের সুপথে পরিচালনা না করে- তবে, চোর-পুলিশ খেলা চলতেই থাকবে। আসুন, নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাই সজাগ হই।’













