সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
কক্সবাজারে সব পেশার মানুষের মাঝে জেঁকে বসছে করোনা। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। সোমবার একদিনেই আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন দুই নারীসহ ৫ জন। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে স্থাপিত করোনা ল্যাবে সোমবার ২৮৩ জনের স্যাম্পল টেস্টে ৯২জনের করোনা ‘পজেটিভ’ ফল মিলেছে। দিন দিন রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়ায় আতংক ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। রোগীর সেবা ও মৃতদেহের সৎকারে স্বজনরা কাছেও ভিড়ছে না। সাধারণ অসহায় মানুষের খুঁজ নিতেও ভয় পাচ্ছেন অনেক দানবীর।
এই চরম মুহূর্তে করোনার উপসর্গে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের কাফন-দাফন, আইসোলেশনে প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করণ ও করোনায় অসহায় হয়ে পড়া মানুষগুলোর দ্বারে দ্বারে সহযোগিতার উপহার পৌঁছে দেয়াসহ সাবান-স্যানিটাইজার ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে করোনা যুদ্ধে অবিচল মাঠে কাজ করছে কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের মানবিক টিম ও তাকওয়া ফাউন্ডেশন।
গত ২৬ মার্চ থেকে অর্ধশত উদ্যমী তরুণদের নিয়ে গঠিত এ টিম দুটির সদস্যরা যেকোন প্রয়োজনে রামু ও সদর উপজেলার প্রত্যন্তাঞ্চলে চষে বেড়াচ্ছে।
জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত ছাত্রলীগের মানবিক টিম ও তাকওয়া ফাউন্ডেশনের হুজুরদের সমন্বয়ে করোনায় মৃতদের কাফন-দাফনের কাজ করা হচ্ছে। সোমবার ভোরে ও সকালে করোনায় মারা যাওয়া শহরের দু’যুবককে নিজেদের তত্বাবধানে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করেছেন এ দুটিমের সদস্যরা।
জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম সাদ্দাম হোসাইন জানান, সোমবার শহরের দুই তরুণ করোনায় মারা যান। এদের মাঝে পাহাড়তলীর এসারুল হক (৪০) আগে থেকেই করোনা পজিটিভ আর নুনিয়ারছরার মাহমুদ করিম (৩০)’র করোনার উপসর্গ ছিল কিন্তু রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি। তাদেরই পরিবার থেকে দাফন-কাফনে সহযোগিতার জন্য ফোনে যোগাযোগ করা হয়। খবর পেয়ে তাকওয়া ফাউন্ডেশনের হুজুরদের সমন্বয়ে কক্সবাজারে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের দাফনে ছুটে যায় আমরা।
সাদ্দাম আরো জানায়, শহরে পৌঁছে তাকওয়া ফাউন্ডেশন ও ছাত্রলীগের কর্মীরা মৃতের গোসল, কাফন, জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা শুরু করেন। তাকওয়ার মৌলানা ক্বারি আজিজুর রহমানের ইমামতিতে দুটি জানাজা সম্পন্ন করে তাদের কবরস্থ করা হয়।
ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দামের মতে, প্রকৃতির এই কঠিন সময়ে মানুষ খুবই অসহায় হয়ে পড়েছে অদৃশ্য করোনা শক্তির কাছে। করোনায় আক্রান্ত বেশির ভাগ মৃত ব্যক্তির কাছে যাচ্ছেন না স্বজনরা। এ পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়, মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ হয়ে রামু উপজেলা ছাত্রলীগের সমমনা তারুণ্যের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করি।
‘গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিন উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা তারেক, ইমরান, এনাম, আজাদ, শাহিন, নয়ন, আশিককে নিয়ে প্রথমে ৮জনের একটি টিম গঠন করা হলে দাফন-কাফনে যেহেতু আমরা তেমন পারদর্শী নয় তাই তাকওয়া ফাউন্ডেশনের এক হুজুরের সাথে পরামর্শ করা হয়। রামুর পূর্ব মেরংলোয়া জামে মসজিদের খতিব আব্দুল মান্নানকে টিম প্রধান করে হাফেজ সাইফুল ইসলাম, হাফেজ মুহাম্মদ সাইদ, হাফেজ সৈয়দ করিম, হাফেজ মুহাম্মদ ইউছুপ, হাফেজ মুহাম্মদ জামিলকে টিম সহকারী করে ১৩জনকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ দাফন টিম আমাদের সাথে কাজশুরু করে।’
এসএম সাদ্দাম হোসাইন আরো বলেন, টিম প্রতিষ্ঠার পর প্রথমে করোনা বিষয়ে সচেতনতামুলক প্রচারণা চালানো হয়। জীবানু নাশক তরল তৈরি করে প্রত্যন্তাঞ্চলে স্প্রে করা এবং অসহায়দের মাঝে খাবার পৌঁছে দেয়ার কাজ করা হয়েছে। এসব দেখে স্ব-ইচ্ছায় টিমে তরুণরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
‘এখন আমাদের টিমে ৫০ জন সদস্য রয়েছে। এদের ৫ ভাগে ভাগ করে এক টিমকে করোনা মোকাবেলায় বিভিন্ন সচেতনমূলক কার্যক্রম, আরেক টিমকে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে রোগী পৌঁছে দেওয়া, আরেক টিমকে অসহায় মানুষের ঘরে ঘরে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার স্টিকার লাগিয়ে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, আরেক টিমকে আইসোলেশন সেন্টারে ভর্তিকৃত রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেয়া, অপর টিমকে সব্জি চাষিদের ক্ষেতে পাঠিয়ে বাজার দামের চেয়ে প্রতি কেজি ৫টাকা বেশি দামে সবজি কিনে বিনামূল্যে বিতরণ এবং আরেক টিম দাফন-কাফনে সহযোগিতা করছে। টিমের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশনায় প্রান্তিক কৃষকের ধান কাটার কাজেও সহযোগিতা করেছে।’
সাদ্দামের মতে, ত্রাণের অর্থ এসেছে টিম মেম্বারদের পকেট খরচ ও পরিবার থেকে স্বেচ্ছায় দেয়া টাকায়। তাদের ভালো উদ্যোগ দেখে দেশের এবং প্রবাসের অনেকে তাদের সাথে সামর্থ অনুসারে যুক্ত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে স্থাপিত ল্যাবে গত ৬১ দিনে (সোমবার পর্যন্ত) ৭ হাজার ৪৮ জন সন্দেহজনক রোগীর করোনা টেষ্ট করা হয়। তারমধ্যে ৮৭৩ জনের করোনা পজেটিভ পাওয়া যায়। এতে সোমবারে ২৮৩ জন নমুনা পরীক্ষায় ৯৬ জন পজেটিভ পাওয়াদের মাঝে নতুন হিসেবে শনাক্ত হয়েছে ৯২জন। অপর ৪ জন রোগীর ফলোআপেও পজিটিভ এসেছে। এদিনের ৮৪ জনসহ কক্সবাজার জেলার রোগী রয়েছে ৭৮৯ জন। এরমধ্যে কক্সবাজার সদরে ৩২১জন। সাথে রয়েছে ৩৪ জন রোহিঙ্গাও রয়েছে। অন্যান্যরা কক্সবাজারের নিকটবর্তী বান্দরবান জেলা এবং চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়ার বাসিন্দা।
প্রশাসনের দেয়া তথ্য মতে, ইতোমধ্যে করোনায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন দেড় শতাধিক। সোমবার সকালে দু’তরুণ ও দু’নারীসহ মারা গেছেন ১৮ জন। এরমধ্যে সদর উপজেলায় মৃত্যুবরণ করেছেন ১১জন। বাকিরা রামু, চকরিয়া, কুতুবদিয়া ও টেকনাফের। জেলা সদরে মৃত্যু বরণ করাদের ছাত্রলীগের মানবিক টিম ও তাকওয়া ফাউন্ডেশন দাফন করলেও কুতুবদিয়ায় করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতকে দাফন করেছে ওসি দিদারুল ফেরদৌসের নেতৃত্বে কুতুবদিয়া থানার পুলিশ। অন্যান্য এলাকায় মৃতদেরও প্রশাসনের সহযোগিতায় দাফন সম্পন্ন করা হয়।
বাংলাধারা/এফএস/টিএম/এএ













