কক্সবাজার প্রতিনিধি »
কক্সবাজার সদরের পিএমখালীতে মধ্যযুগীয় কায়দায় মোরশেদ আলী ওরফে বলী মোরশেদ হত্যায় অভিযুক্ত ৪ আওয়ামী লীগ নেতাকে সদর আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) সন্ধ্যায় সদর আ.লীগের আহবায়ক মাহমুদুল করিম মাদু, যুগ্ম আহবায়ক জসিম উদ্দিন, ছৈয়দ রেজাউর রহমান রেজা, টিপু সুলতান দলীয় প্যাডে সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছেন।
বহিষ্কৃত নেতারা হলেন— সদর আওয়ামী লীগের সদস্য আব্দুল মালেক, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, আবু তাহের ও সিরাজুল মোস্তফা আলাল। এদের মাঝে আলাল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন।
অপরদিকে, একই অপরাধে সদর যুবলীগ সভাপতি আবদুল মালেক ও আক্কাসকে সদর উপজেলা যুবলীগের দায়িত্ব থেকে আর আরিফুল ইসলামকে পিএমখালী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতির পদ হতে অপসারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা যুবলীগ সভাপতি সোহেল আহমেদ বাহাদুর রানা।
মঙ্গলবার রাতে দলীয় প্যাডে সভাপতি স্বাক্ষরিত ও জেলা যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ ফারুকের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এর আগে মোরশেদ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে সদর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ উভয় কমিটির দায়িত্বশীল আব্দুল মালেককে প্রধান আসামী করে ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা জানায় পুলিশ।
তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও, ঘটনার ৬দিন অতিবাহিত হবার পরও উল্লেখ যোগ্য কেউ এখনো আটক হননি। তাই, অপরাধীরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে, যেকোন সময় এলাকায় ফিরতে পারেন বলে শংকা প্রকাশ করেন স্থানীয়রা।
কক্সবাজার জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, প্রকাশ্যে মোরশেদ বলিকে হত্যার অভিযোগে ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এদের মাঝে ডজনাধিক ব্যক্তি আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল। এদের নৃশংসতার কারণে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তার দায়ভার তো সদর আওয়ামী লীগ নিতে পারে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারায় তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সন্ত্রাসীদের আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত থাকার কোনো সুযোগ নেই, এটি দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ। এ দলে ভূমিদস্যু, চাঁদাবাজ, হুকুম দখল-খারাপ মানুষের জায়গা নেই।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) আছর নামাজের সময় মায়ের জন্য ইফতার অনুষঙ্গ কিনতে চেরাংঘর বাজারে আসেন মোরশেদ আলী। সেখানেই অকস্মাৎ দুর্বৃত্তরা তার উপর মধ্যযুগীয় কায়দায় পৈশাচিকতা চালায়। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত ৮টার দিকে আইসিইউতে তার মৃত্যু হয়। সৌদি প্রবাসী মোরশেদ বেড়াতে দেশে এসেছিলেন। তিনি এলাকায় ‘অন্যায়ের প্রতিবাদকারী’ হিসেবে পরিচিত। দেশে ঘুরতে আসলে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বলীখেলায় শখের বসে অংশ নিতেন বলে তাকে মোরশেদ বলী নামেও ডাকা হতো।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিল্ডিং ভাঙার কাজে ব্যবহৃত বিশালাকার হাতুড়ি দিয়ে প্রথম আঘাতে মাটিতে পড়ে যান মোরশেদ। ঘটনার আকস্মিকতা উপলব্ধি করতে পেরে হামলাকারীদের বলছিল— ‘আমি রোজায় বেশি ক্লান্ত, ইফতারের সুযোগ দাও, মারতে চাইলে ইফতারের পর মারিও।’
কিন্তু রোজাদার বলার আকুতিও নরপশুদের দমাতে পারেনি। শেষ রক্ষা হয়নি প্রয়াত শিক্ষক ওমর আলীর ছেলে মোরশেদ আলী ওরফে বলী মোরশেদের।
হত্যা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাবাজার এলাকার আলী আহমদ কোম্পানি জানান, বাজার করতে চেরাংঘর বাজারে পৌছার একটু পরে শোরগোল শুনতে পান। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি গেলে পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন হাজারিকে বলতে শোনা যায়, ‘উপরের নির্দেশে তারে (মোরশেদ) মেরে ফেলা হচ্ছে, কেউ সামনে আসবে না। যারা আসবে তাদেরও অবস্থা খারাপ হবে।’
এসময় আবদুল মালেকসহ ১৫-২০জন সন্ত্রাসী মোরশেদকে বরফ ধোলাইয়ের মতো প্রহার ও কোপাচ্ছিল। সবাইকে তদারকি করছিলেন পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা আলাল। এলোপাতাড়ি মারধর ও কোপানোর ফলে মোরশেদ একটু নিস্তেজ হয়ে গেলে কয়েক রাউন্ড ফাকা গুলি বর্ষণ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে হামলাকারীরা।
এলাকাবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আওয়ামী লীগ পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ান আলাল-মালেকের বিশাল এক সিন্ডিকেট। তারা পাহাড় কাটা, বন দখল, জমি দখল, বিচারের নামে প্রহসন, চাঁদাবাজি, ইয়াবা বেচাকেনাসহ নানা অপরাধ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুরাে ইউনিয়ন জুড়েই তাদের রাজত্ব। ভারী অস্ত্র থাকায় ভয়ে মুখ খোলে না কেউ। প্রতিবাদ করলেই মোরশেদ বলীর মতো জীবন দিতে হবে। ইউনিয়ন জুড়ে কেউ জমি ক্রয়- বিক্রয় বা দালান করলে তাদের চাঁদা দিতে হয়। তা না হলে সিন্ডিকেটটি কোনো কাজই করতে দেয় না। প্রশাসন নিরবে তদন্ত করলে এমন সব অসংখ্য অভিযোগের সত্যতা পাবে।
তারা আরও জানায়, মোরশেদ হত্যায় অংশ নেয়া আবদুল মালেক, তাহের, মতিউল ইসলাম মতি, সিরাজুল মোস্তফা আলালসহ বেশ কয়েকজন একাধিক মামলার দাগি আসামি। এর মধ্যে আবদুল মালেক ও মতি সদ্য জেল ফেরত বলে উল্লেখ করেন তারা।
কক্সবাজার সদর থানার ওসি শেখ মুনীর উল গীয়াস বলেন, নৃশংস এ ঘটনায় অভিযুক্তদের ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় তাদের ধরতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে।