বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে নানা প্রস্তুতি ও ঢাল ঢোল বাজিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আয়োজিত সাত দিনের পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভালের বর্ণাঢ্য যাত্রায় হোঁচট খেয়েছে প্রশাসন। নানা বাজনা বাজিয়ে রাজকীয় আয়োজনের কথা বলা হলেও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগ করেছে মাত্র অর্ধ শত দর্শক। উৎসব ঘীরে সৈকতের লাবণী পয়েন্টের মেলার মঞ্চ ঘীরে তৈরি করা হয়েছে দুই শতাধিক স্টল। কিন্তু বুধবার সকাল ১০ টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলাকালিন মাত্র কয়েকটি স্টল খোলা ছিল। এমনকি বিকাল ৫টা এসেও অর্ধেকের বেশি স্টল বন্ধ ছিল।
একই সঙ্গে মেলা উপলক্ষে পূর্ব ঘোষিত বিশেষ ছাড়ের কথা বলা হলেও তা ব্যবসায়ীরা মানছে না বলে অভিযোগ করেছেন পর্যটকরা।
বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে বুধবার সকাল ১০ টায় একটি র্যালী বের করা হয়। র্যালীটি সৈকতের আশে-পাশের এলাকা ঘুরে লাবণী পয়েন্টে এসে শেষ হয়। যেখানে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে সাত দিনের পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভালের উদ্বোধন করেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান।
উদ্বোধনীতে প্রধান অতিথি ছিলেন কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল। বক্তব্য রাখেন, সংসদ সদস্য জাফর আলম, সংসদ সদস্য কানিজ ফাতেমা মোস্তাক, আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান, ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি মো. জিল্লুর রহমান, কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের ও সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুল ইসলাম, কক্সবাজার পৌর মেয়র মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।
র্যালীতে পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানা সংগঠনের পক্ষে ব্যানার সহকারে উপস্থিতি দেখা গেলেও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল ছিল একে বারেই ফাঁকা। ৫০-৬০ জনের উপস্থিতিতে চলে পুরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।
উৎসব ঘীরে সৈকতের লাবণী পয়েন্টের মেলার মঞ্চ ঘীরে সড়কের উভয় পাশে তৈরি করা হয়েছে দুই শতাধিক স্টল। কিন্তু ওই সব স্টল ছিল ফাঁকা। কয়েকটিতে টেবিল চেয়ার নিয়ে লোকজন বসে থাকলেও অন্যদের পাওয়া যায়নি। এমনকি বিকালেও অর্ধেক স্টল ফাঁকা দেখা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লোকজন জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসন পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানা সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এসব স্টল বরাদ্ধ প্রদান করে নির্ধারিত অংকের টাকা নিয়েছেন। কিন্তু যারা স্টল বরাদ্ধ নিয়েছেন তারা কি স্টল করবে তাও নিশ্চিত হতে পারেনি বলেই এখনও বন্ধ আছে।
এছাড়া উৎসব উপলক্ষে হোটেল-মোটেল থেকে শুরু করে খাবারের রেস্তোরাঁ, কিটকটসহ পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠানে ‘বিশেষ ছাড়’ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
পর্যটন মেলার আহ্বায়ক ও কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন জানিয়েছিলেন, পর্যটন মৌসুমকে বরণে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত সব হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউসে ৬০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হবে। একই সঙ্গে খাবারের রেস্তোরাঁয় ১৫ শতাংশ, সব বাস ভাড়ায় ২০ শতাংশ, হেলিকপ্টার জয় রাইডে ১০ শতাংশ, টায়ার টিউব ভাড়ায় ৩০ শতাংশ, কিটকট (ছাতা-চেয়ার) ভাড়ায় ৩৩ শতাংশ, ফটোগ্রাফারদের মাধ্যমে ছবি তোলা প্রতি কপি দুই টাকা, প্যারাসেইলিং রাইডে ৩০ শতাংশ, জেটস্কি ও বিচ বাইক রাইডে ৩৩ শতাংশ, লকার ভাড়ায় ৫০ শতাংশ, গাড়ি পার্কিংয়ে ৫০ শতাংশ, ফান গেমে ৫০ শতাংশসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট ১৫টি খাতে বিশেষ ছাড় ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও বিনামূল্যে সার্কাস শোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিন্তু কার্যত তারকা হোটেল ছাড়া অন্য হোটেল ও গেস্ট হাউসে ছাড়ের নামে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা থেকে আগত এক দম্পতির দেয়া তথ্য মতে, আবাসিক হোটেল-মোটেলে প্রতি কক্ষ ভাড়া ছাড়ের পরিবর্তে অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে।
এই দম্পতি একটি আবাসিক হোটেলের নাম উল্লেখ করে বলেন, কলাতলীর একটি মাঝারি মানের আবাসিক হোটেলের একটি কক্ষ ভাড়া তাদের কাছে রাখা হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এই কক্ষটির ভাড়ার দেড় হাজারের বেশি হওয়ার কথা না।
উৎসব চলাকালিন সময়ের মধ্যে বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) পড়েছে ঈদে মিলাদুন্নবী। শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। তিনদিনের ছুটিতে কক্সবাজারে লাখো পর্যটকের সমাগম হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এই উপলক্ষে অগ্রিম বুকিংয়ের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত দাবির অভিযোগ উঠেছে ইতিমধ্যে।
বুধবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কলাতলীর আবাসিক হোটেল-মোটেল ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিষ্ঠানে কক্ষ খালি নেই বলে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে অতিরিক্তি টাকা দেয়ার আশ্বাস দিলে মিলছে কক্ষ।
এদিকে, উৎসব উদ্বোধনের অংশ হিসেবে বৃক্ষরোপণ ও বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে মহেশখালী জেটি পর্যন্ত নৌ-র্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সৈকতের বালিয়াড়িতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বালির ভাস্কর্য করা হয়েছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের পুলিশ সুপার জিল্লুর রহমান বলেন, পর্যটনমেলা ও বিচ কার্নিভাল এবং তিনদিনের ছুটিতে কক্সবাজারে ব্যাপক পর্যটক সমাগম হবে। পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে এ মেলা ও বিচ কার্নিভালের আয়োজন করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, নানা বৈচিত্র্যে ভরা সাত দিনের এ উৎসবের রং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে পূর্ব ঘোষিত ছাড় নিশ্চিত করে উৎসব জমজমাট করতে উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন তিনি।
মেলায় কোন দিন কী অনুষ্ঠান
শুক্রবার: বিকেল তিনটার দিকে ঘুড়ি উৎসব, বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সেমিনার, সাড়ে ৫টার দিকে ম্যাজিক শো। সন্ধ্যা ৬ টা ২০ মিনিটে ফায়ার স্পিন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে লাইফ গার্ড রেসকিউ প্রদর্শনী, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এর আগে রাত ৯টার দিকে ফানুস উৎসব ও রাত ১১টার দিকে ডিজে শো।
শনিবার: সকাল ১০টার দিকে সার্ফিং প্রদর্শনী, বিকেল তিনটার দিকে ঘুড়ি উৎসব, বিকেল চারটার দিকে বিচ ম্যারাথন, বিকেল ৫টার দিকে সেমিনার, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ডিজে শো।
রোববার: বিকেল ৫টা থেকে সেমিনার ও সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেক সোমবার: বিকেল ৪টায় বিচ ভলিবল, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাত ৮টায় বিদেশি নাগরিকদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও রাত ১১টায় ডিজে শো।
মঙ্গলবার: বিকেল তিনটার দিকে সেমিনার, বিকেল চারটার দিকে পুরস্কার বিতরণ ও সমাপনী অনুষ্ঠান, বিকেল পাঁচটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্র্যান্ড সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কনসার্ট, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ডিজে শো ও রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে আতশবাজি। আর কার্নিভালের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করবে দেশের বিখ্যাত ব্যান্ড দল চিরকুট, আভাস, সুনামগঞ্জের শাহ আবদুল করিমের দল, কুষ্টিয়ার লালন গীতির দল, সিলেট, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহের পালা গানের দলসহ জনপ্রিয় ব্যান্ড ও সংগীত শিল্পীরা। নৃত্য পরিবেশন করবেন তিন পার্বত্য জেলা- বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিসহ কক্সবাজারের রাখাইন সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা।













