১৬ ডিসেম্বর ২০২৫

কক্সবাজারে ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে ৬ রোহিঙ্গাসহ নিহত ১৫, নিখোঁজ ৩

সায়ীদ আলমগীর  »

কক্সবাজার জেলা জুড়ে টানা ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। অতিবর্ষণে পাহাড়ি ঢল, পাহাড় ধ্বস ও বানের পানিতে তলিয়ে গিয়ে গত ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে নারী-শিশুসহ ১৫ জন নিহত হয়েছে। এদের মাঝে বুধবার ভোররাতে পাহাড় ধ্বসে মাটিচাপায় টেকনাফের হ্নীলা পাহাড়ের পাদদেশে একই পরিবারের ৫ জন নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুটি পরিবারে ৫ জন নিহতের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। বাকিরা পৃথক ভাবে পাহাড় ধ্বস ও বানের জলে তলিয়ে মারা যায়। এ ছাড়াও ঢলের পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে ঈদগাঁওতে নিখোঁজ রয়েছে তিনজন।

গত তিনদিনের অব্যাহত বৃষ্টির ফলে জেলার নয় উপজেলার প্রায় প্রতিটি এলকায় পানিবন্দি অবস্থায় দুর্ভোগে রয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। ঈদগাঁও ফুলেশ্বরী নদীর ঢলের তোড়ে ধসে গেছে ‘ঈদগাঁও-ঈদগড়-বাইশারী’ বাণিজ্যিক সড়কের প্রায় ১০০ ফুট এলাকা।

টেকনাফ:

টেকনাফে পাহাড় ধসে একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হয়েছে। বুধবার (২৮ জুলাই) ভোররাত ২টার দিকে টেকনাফ উপজেলারর হ্নীলা ইউনিয়নের ভিলেজারপাড়ার সৈয়দ আলমের বাড়িতে এ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এসময় মাটির নিচে চাপা পড়ে যাওয়া সৈয়দ আলমের ৫ সন্তানের মৃতদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা।

নিহতরা হলো টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের পাহাড়ি গ্রাম ভিলেজার পাড়া এলাকার সৈয়দ আলমের ছেলে আব্দু শুক্কুর (১৬), মোহাম্মদ জুবাইর (১২), আবদুর রহিম (৫), মেয়ে কহিনুর আক্তার (৯) ও জয়নবা আক্তার (৭)।

মঙ্গলবার পাহাড় ধ্বসে টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকায় রকিম আলী (৪৭) নামে একজন নিহত হন। তিনি হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মনিরঘোনা গ্রামের মৃত আলী আহমদের ছেলে বলে জানিয়েছেন হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজ চৌধুরী বলেন, ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে হ্নীলায় একই পরিবারের পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের পরিবারে আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হয়েছে।

উখিয়া:

ভারী বর্ষণে কক্সবাজারে উখিয়ায় পাহাড় ধ্বসে ও পানিতে ডুবে শিশুসহ ৬জন রোহিঙ্গা এবং একজন স্থানীয় নিহত হয়েছে। এসময় আহত হয়েছে অন্তত আরও ৫ জন। বুধবার পালংখালীতে ও মঙ্গলবার উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় পাহাড় ধসে নিহত হন তারা।

নিহতরা হলেন, উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চোরাখোলা এলাকার মৃত আলী আহমদের ছেলে আবদুর রহমান (৪৫)। পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, আবদুর রহমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বানের জলে ভেসে যান। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চোরাখোলা খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। এছাড়া মঙ্গলবার উখিয়ার বালুখালী ১০নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জি-৩৭ ব্লকের নুর মোহাম্মদের মেয়ে নুর নাহার (৩০), শাহা আলমের ছেলে শফিউল আলম (১২), জি-৩৮ ব্লকের ইউসুফের স্ত্রী দিল বাহার (২৪) ও তাদের ২সন্তান আব্দুর রহমান (৪) ও আয়েশা ছিদ্দিকা (২) পাহাড় ধসে মারা যান। একইদিন ৮ নম্বর ক্যাম্পে বানের জলে ভেসে বাহার নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। এসময় আহতরা হলেন, শাহ আলমের মেয়ে নুর ফাতেমা (১৪) ও জানে আলম (৮)।

মহেশখালী:

দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীততে পৃথক দুটি ইউনিয়নে এক বৃদ্ধ এবং এক কিশোরী পাহাড় ধসে নিহত হয়েছেন। নিহত বৃদ্ধ আলী হোসেন (৬৮) হোয়ানক ইউনিয়নে রাজুয়ার ঘোনার মৃত রফিক উদ্দিনের ছেলে। ঘুমন্ত অবস্থায় পাহাড় ধ্বসে তাদের বাড়ির উপর পড়লে তিনি মারা যান।

অরপদিকে, মহেশখালী উপজেলার ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের সিপাহীপাড়া এলাকায় পাহাড় ধসে মোর্শেদা বেগম (১৪) নামে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও দুইজন। মৃত মোর্শেদা বেগম ওই এলাকার আনসার হোসেনের মেয়ে।

সূত্র মতে, সোমবার সকাল হতে শুরু হওয়া ভারি বৃষ্টিপাত থেমে থেমে অব্যাহত রয়েছে। টানা ভারী বর্ষণে কক্সবাজার জেলার শতাধিক নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে সমতলও। পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়া, রামু, পেকুয়া, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি বন্দি অবস্থা পার করছে কক্সবাজার শহরের বাজারঘাটা, কলাতলী, চরপাড়া, কাঙ্গালী পাড়া, সমিতি পাড়া, নাজিরারটেক, সদর উপজেলার খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, পিএমখালী, পোকখালী, মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, ঘটিভাঙ্গা, পেকুয়ার মগনামা, উজানটিয়া, চকরিয়ার লইক্ষারচর, কাকারা, বরইতলী, পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড, কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, আলী আকবর ডেইল ও তাবলারচর এলাকা, ঈদগাঁও উপজেলার সদরের ভোমরিয়াঘোনা, দরগাহপাড়া, চৌধুরী পাড়া, পালপাড়া, মাইজপাড়া, ইসলামাবাদ, ইসলমাপুর ও জালালাবাদের পালাকাটা, সওদাগর পাড়া, বাজার এলাকাসহ পাশবর্তী এলাকার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। একই সাথে সাগরের জ্বলোচ্ছ্বাস ও পাহাড়ী ঢলে কয়েক হাজার একরেরও বেশি চিংড়ি ঘেরের মাছ তলিয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে পানের বরজ ও ধানসহ বিভিন্ন সবজির ফসল।

ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ছৈয়দ আলম জানান, ঈদগাঁও ফুলেশ্বরী নদীর ঢলে ডুবে থাকা দরগাহপাড়া-ভাদিতলা মুক্তিযোদ্ধা ছুরুত আলম সড়কের কাঠের সাঁকো এলাকায় বুধবার (২৮ জুলাই) দুপুরে মাছ শিকার কালে দু’সহোদরসহ তিনজন স্রোতে তলিয়ে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছে।

নিখোঁজরা হলো, দরগাহপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ শাহাজাহানের দুই ছেলে মোহাম্মদ ফারুক (২৬) ও দেলোয়ার হোসেন (১৫) এবং আবছার কামালের ছেলে মোহাম্মদ মোরশেদ (১৪)। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধারে তৎপরতা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়।

রামু ফায়ার ষ্টেশন কর্মকর্তা সৌমেন বড়ুয়া বলেন, প্রবল বর্ষণ ও ঢলের কারণে উদ্ধার কাজে ব্যহত হচ্ছে। এখনো তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাদের উদ্ধারে চট্টগ্রাম থেকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল আসছে।

কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারি আবহাওয়াবিদ মো. আবদুর রহমান জানিয়েছেন, মঙ্গলবারের মতো বুধবারও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সোমবার ১২ টা হতে বুধবার ১২টা পর্যন্ত ৩৬ ঘন্টায় কক্সবাজার জেলায় ১৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামীকালও ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল সমুহে পাহাড় ও ভূমি ধসের সম্ভাবনা রয়েছে। সাগরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বলবৎ থাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিককের চেয়ে কয়েকফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মামুনুর রশীদ জানান, শ্রাবণের অতিবর্ষণে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। ঢল নেমেছে ঈদগাঁওর ফুলেশ্বরী, চকরিয়ার মাতামুহুরি ও রামুর বাঁকখালীতে। জলমগ্ন হয়েছে জেলার নয় উপজেলার সমতলও। শত শত বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে জলবন্দী হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। ডুবে গেছে রাস্তা-ঘাট। জেনেছি রান্নাও বন্ধ রয়েছে অনেক পরিবারে। উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া রয়েছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মানুষের দূর্ভোগ লাগবে কাজ করার।

ডিসি আরো জানান, টেকনাফ-উখিয়া ও মহেশখালীতে পাহাড় ধ্বসে নিহত সকলের পরিবারে প্রশাসনের পক্ষ হতে আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড় ধ্বসে এবং বানের পানিতে ভেসে এ পর্যন্ত ১৫ জন নিহত হয়েছে বলে খবর পেয়েছি। মৃত্যুর ঝুঁকি এড়াতে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারিদের সরিয়ে নিতে মাইকিং ও অভিযান চলছে।

বাংলাধারা/এফএস/এআর

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ