সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও কক্সবাজারে সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলার আট উপজেলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে চাষের বিপরীতে চলতি বছর সুপারি উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার মেট্রিকটন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত সুপারি সারাদেশে সরবরাহের পাশাপাশি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও। পাইকারি বাজারদর হিসেবে চলতি বছরে উৎপাদিত সুপারি বিক্রয় করে প্রায় দুইশত ৫০ কোটি টাকা আয় হবার সম্ভাবনা দেখছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তবে, খুচরা বাজারে দাম আরো বাড়তি মিলছে। সেই হিসেবে উৎপাদিত সুপারির বিপরীতে আয় তিনশত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা কৃষি সংশ্লিষ্টদের। এতে সুপারি চাষি পরিবার ও ব্যবসায়ীরা বেজায় খুশি। প্রতিবছর লাভের মুখ দেখায় বাণিজ্যিক সুপারি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে অনেক পরিবার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কক্সবাজার কার্যালয়ের উন্নয়ন শাখার উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা আশীষ কুমার দে জানান, কক্সবাজার জেলায় চলতি বছর ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর ভুমিতে সুপারি চাষ হয়েছে। এতে টেকনাফে এক হাজার ২৮০ হেক্টর, উখিয়ায় এক হাজার হেক্টর, কক্সবাজার সদরে ৭৫০ হেক্টর, রামু উপজেলায় ৪৫০ হেক্টর, মহেশখালীতে ৫ হেক্টর, চকরিয়ায় ৬ হেক্টর, কুতুবদিয়ায় ৩ হেক্টর ও পেকুয়ায় ৬ হেক্টর ভুমি সুপারি চাষের আওতায় এসেছে এ মৌসুমে। এসব জমিতে প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ সুপারির গাছ থেকে এসব উৎপাদন এসেছে।
তিনি আরো বলেন, হিসাব মতে প্রতি হেক্টরে সাড়ে তিন থেকে চার টন সুপারি উৎপাদিত হয়েছে। সে অনুপাতে এবারের ফলন উঠবে প্রায় ১৩ হাজার মেট্রিকটন। প্রতিপণ (৮০পিস) বা কেজি প্রতি সুপারি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। সে হিসাবে এবারে সুপারি বিক্রি করে আয় হবে প্রায় ২৪৫-৩০০ কোটি টাকার মতো। গত মৌসুমে সুপারি চাষের আওতায় ছিল ৩৪০০ হেক্টর জমি।
সূত্রমতে, আদিকাল থেকেই টেকনাফ-উখিয়ার সুপারির কদর দেশে। টেকনাফের সুপারির সাথে মহেশখালীর পান নিয়ে লোকজগানও রয়েছে বেশ। প্রাচীনকাল থেকেই দেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত শহরে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল সুপারির বাগান। পাশাপাশি কমবেশি সুপারি বাগান রয়েছে জেলার প্রতিটি উপজেলায়। কক্সবাজারের প্রায় এলাকায় পান দিয়ে অতিথি আপ্যায়নের রীতি চলমান। ফি’বছর সুষ্ক মৌসুমেই একসাথে নামে পাকা সুপারি। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে টেকনাফ-উখিয়াসহ জেলার হাট-বাজারে জমে উঠেছে সুপারির হাট। প্রথম দিকে দাম কম পেলেও এখন বাজারে সুপারির ভালো দাম পেয়ে খুশি চাষীরা।
কক্সবাজারের ঈদগাঁও এলাকার সুপারি ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হক (৫৫) বলেন, প্রাচীন কাল থেকে কক্সবাজারে বাড়ি-ভিটার পরিত্যক্ত জমি, বাড়ির চালার কিনারা ঘেষা বা খেতের আটিতে সুপারি চাষ হয়ে আসছে। চাষী পরিবারগুলো ছোট-বড় বাগান করে সুপারি উৎপাদন করতো। কিন্তু ৮০ দশকে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে বৈধ-অবৈধ পথে বিপুল পরিমাণ শুকনা সুপারি এদেশে আসতো। চোরাই পথে আসা মিয়ানমারের সুপারিতে এদেশের হাট-বাজার সয়লাব হতো বলে দেশীয় সুপারি কম বাজারজাত হতো আর ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত হতো ছোট-বড় চাষীরা। ফলে সুপারি চাষে অনেকটাই নিরুৎসাহিত হতো স্থানীয়রা। কিন্তু ১৯৯১ সালে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা নাগরিক এদেশে আশ্রয় নেয়ার পর সে দেশ থেকে সুপারি পাচার ধীরে কমতে থাকে। এদিকে চাহিদা বাড়তে থাকে স্থানীয় সুপারির। গত ২০১৭ সালে আবারো বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রিত হবার পর সুপারির চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে বেড়েছে সুপারির দামও। ফলে পরিত্যক্ত অকৃষি জমিগুলোতে সুপারির চাষাবাদ বাড়িয়েছে গৃহস্তরা। গত কয়েক বছর ধরে সুপারির ফলন ভালো হচ্ছে।
উখিয়ার সোনার পাড়ার আব্দুস সালাম, রাসেল মোহাম্মদ জানান, অগ্রহায়ণ ও কার্তিক মাস সুপারির ভরা মৌসুম। এবারে আশ্বিন মাসের শেষের দিকে বাজারে আসতে শুরু করে সুপারি। উখিয়া-টেকনাফ সমুদ্র উপকূলীয় হওয়ায় এখানকার মাটি ও আবহাওয়া সুপারি বাগানের উপযোগী। তাই এসব এলাকায় প্রতিটি ঘরে কম বেশি সুপারি বাগান রয়েছে। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে শত শত একর জায়গায় সুপারি বাগান গড়ে তোলা হচ্ছে।
দেখা গেছে, জালিয়াপালং ইউনিয়নের সোনার পাড়া, ইনানী, নিদানিয়া, মাদার বুনিয়া, ছেপট খালী ও মনখালি এলাকায় দিগন্ত জোড়া গ্রামে সুপারি বাগান। পুরো বাগান জুড়ে সুপারির বাম্পার ফলন। রত্নাপালং, রাজাপালং, পালংখালী হলদিয়া পালং ইউনিয়নে অসংখ্য সুপারির বাগান রয়েছে। একইভাবে টেকনাফের শাপলাপুর, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং, হ্নীলা টেকনাফ সদরসহ বিভিন্ন গ্রামে প্রচুর পরিমাণ সুপারি বাগান দৃশ্যমান। এসব গ্রাম থেকে সংগ্রহকরা পাকা সুপারিতে সয়লাব হয়ে আছে সোনারপাড়া, শাপলাপুর বাজার। মৌসুমী হিসেবে বসছে বাহারছড়ায় বিশাল সুপারি বিকিকিনির হাট।
ব্যবসায়ী শাকের উদ্দিন সাগর ও আবুল কালাম জানান এবছর সুপারির প্রতি পোন (৮০ টি) ৩শত থেকে ৪ শত টাকা এবং প্রতি কাউন (১২৮০টি) সাড়ে ৪ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে মানভেদে দাম আরও বেশি।ও খুব খুশি।
উখিয়ার পান-সুপারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সুলতান আহমদ জানান, প্রতি মৌসুমে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন হাট বাজার হতে সুপারি ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন আড়তে চলে যায়। পরে ওইসব সুপারি প্রক্রিয়াজাত হয়ে রপ্তানির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। অর্থকরী ফসল পান-সুপারি উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল এ দু’উপজেলার ৭ হাজারেরও বেশি পরিবার রয়েছে। আর প্রায় প্রতিটি বসত ভিটায় চাষ হয় সুপারি। যা বিক্রি করে পরিবারের বাৎসরিক খরচের একটি মোটা অংশ যোগান এখান থেকে করছে তারা। এ বছর দু’উপজেলায় প্রায় শত কোটি টাকার সুপারি বাজারজাত হবে বলে আশা করছি আমরা।
মেরিন ড্রাইভের মনখালী এলাকার জমির উদ্দিন বলেন, এলাকায় সুপারির ফলন ভালো হওয়ায় অন্যদের মতো ভিটার পরিত্যক্ত জমিতে কিছু সুপারি গাছ লাগানো হয়েছিল। এখন প্রতিবছর ৬-৮ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করে পরিবারের খরচ যোগানো সম্ভব হচ্ছে। তবে, সমুদ্রতীরের ঝাউগাছ নিধন অব্যাহত থাকায় লবণের তীব্রতায় অনেক সুপারি গাছে মড়ক দেখা দিয়েছে।
টেকনাফের বাহারছরা, উখিয়ার সোনারপাড়া ও মরিচ্যা বাজারও পাকা সুপারিতে সয়লাব হয়ে আছে। বাজারের আশপাশের খোলা জায়গায় একাধিক ট্রাক বোঝাই সুপারি দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হচ্ছে। শুকানোর চেয়ে চাহিদার কারণে পাকা সুপারি প্রক্রিয়াজাত হিসেবে ভিজিয়ে রাখা হচ্ছে। মাস-তিনেক পর হতে ভিজানো সুপারি আবার বাজারজাত হবে। এখানকার সুপারি সৌদি আরব, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. কবির হোসেন বলেন, কৃষি নির্ভর অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে আমরা সবসময় সচেষ্ট। মৌসুমী অর্থকরী ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করতে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের তৎপরতায় সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। এ মৌসুমে প্রায় তিনশ কোটি টাকার সুপারি বিক্রয়ের আশা রাখছি। কৃষকেরা লাভবান হওয়ায় এলাকাভিত্তিক সুপারি চাষ ক্রমশ বাড়ছে। এতে উৎপাদনমুখী হচ্ছে অকৃষি পরিত্যক্ত জমিগুলো। সবধরণের কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়াতে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।