সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
কক্সবাজারে করোনায় দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। সাংবাদিক-ব্যবসায়ী-পেশাজীবী ও গৃহিনীসহ মৃত্যুর তালিকায় নাম উঠছে রাজনীতিকসহ নানা শ্রেনীর মানুষের। হাজারের সংখ্যা পার হয়েছে সংক্রমণ। পরিস্থিতি সামাল দিতে কক্সবাজার পৌর এলাকাকে দেশের প্রথম ‘রেড জোন’ চিহ্নিত করে দ্বিতীয়বারের মতো লকডাউন ঘোষণা করা হয় ৬ জুন।
পাশাপাশি ৭ জুন বিকাল থেকে চকরিয়া উপজেলার পৌর এলাকা এবং উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ২, ৩, ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডকেও করোনা সংক্রমণের ‘রেড জোন’ ঘোষণা করা হয়। ৮ জুন থেকে ‘রেড জোন’ চিহ্নিত হয় টেকনাফ ও উখিয়ায়। মৃত্যুর মিছিল দেখে জীবনের তাগিদে স্বেচ্ছায় লকডাউন পালন করছে স্বজন হারানো মানুষ।
আর পুরো জেলার ‘রেড জোন’ এলাকায় লকডাউন নিবিড় ভাবে নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে প্রশাসন। ‘রেড জোন’ ঘোষিত এলাকার প্রধান সড়কগুলোতে সেনা চেকপোষ্ট স্থাপনের পাশাপাশি সেনা টহল কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে। রয়েছে পুলিশী তৎপরতাও। মাঠে থাকা বাহিনীগুলোর কার্যক্রম সমন্বয় করতে মাঠে রয়েছে জেলা প্রশাসনের একাধিক নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলায় ইউএনও-এসিল্যান্ড।
রামু সেনানিবাসের মিডিয়া সমন্বয়ক মেজর তানজিল জানান, ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত এলাকাগুলো পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ থাকবে। তবে অতি জরুরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তাদের কাজের যথার্থতা প্রমাণ সাপেক্ষে ‘রেড জোনে’ সীমিত পরিসরে আসা যাওয়া করতে পারছেন।
লকডাউন এলাকায় সব ধরনের দোকান, মার্কেট, বাজার, হাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। কেবলমাত্র প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী রবিবার ও বৃহস্পতিবার কাঁচাবাজার ও মুদি দোকান স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু থাকবে।
দেখা যায়, কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন প্রবেশপথে সেনাবাহিনীর চেকপোষ্টের পাশাপাশি পুলিশী চেকপোস্টও তৎপর ভূমিকা রাখছে। জরুরি প্রয়োজনে চলাচলরত ব্যক্তিদের পরিচয়পত্র দেখে জিজ্ঞাসাবাদ এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচলের অনুমতি পাচ্ছেন। এত কঠোরতার পরও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইজিবাইক, অটোরিক্সা চলাচল করছিল।
তবে, যেসব এলাকায় মৃত্যু দৃশ্যমান হচ্ছে সেসব এলাকায় জন এবং যান চলাচল একেবারে নেই বললেই চলে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। পর্যটন শহরের লাবণী পয়েন্ট থেকে হলিডে মোড় হয়ে বাজারঘাটা, বাসটার্মিনাল, কালুরদোকান, তারাবনিয়ারছরা, হাশেমিয়া মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন এলাকা ফাঁকাচিত্র দেখা গেছে। শুধু মূল সড়ক নয়, উপসড়কগুলো বন্ধ রয়েছে। মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার দেখলেই থামিয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে কেন বের হয়েছেন, কোথায় যাচ্ছেন? সদুত্তর না মিললেই সেনাসদস্যরা তাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
একইভাবে চকরিয়া, টেকনাফ ও উখিয়ার রেড জোনে কঠোরতা পালন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চকরিয়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ, টেকনাফের ইউএনও সাইফুল ইসলাম ও উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মর্জিনা আকতার।
অপরদিকে, কক্সবাজারের প্রবেশমুখ লোহাগাড়া-চকরিয়া সীমানায় পূর্ব থেকেই সেনা সদস্যরা অস্থায়ী চেকপোস্ট স্থাপন করে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। জরুরি মালামাল নিয়ে আসা যানবাহনগুলোর গায়ে লেগে যেন করোনাভাইরাস জেলায় প্রবেশ না করতে পারে, সে কারণে গাড়িগুলোকে জীবাণুমুক্ত করে দিচ্ছে সেনাবাহিনী। এ লক্ষ্যে শহরের প্রবেশদ্বারে বিশেষায়িত নিজস্ব উদ্ভাবনী সক্ষমতায় একটি বুথ নির্মাণ করেছেন তারা।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, জীবনের প্রয়োজনেই ‘রেড জোন’ চিহ্নিত করে পর্যটন নগরীতে দ্বিতীয়বারের মতো লকডাউন চলছে। মানুষ আগের বার চোর-পুলিশ খেললেও এখন নিকটাত্মীয়সহ মৃত্যুর দীর্ঘ হাতছানি দেখে নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়েই লকডাউন পালন করছেন। যারা এরপরও বাইরে আসছে তাদের বুঝিয়ে ঘরে ফেরানো হচ্ছে।
অসহায়দের খাবারের সংস্থানের বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, যাদের ঘরে খাবার নেই বলে খবর আসবে তাদের সরকারি সহায়তা পৌঁছে দেয়া হবে। হটলাইন নাম্বার এবং ওয়ার্ড বা উপজেলা কমিটির প্রধান যে কারো কাছে নিজেদের দুরাবস্থার কথা জানালেই খোঁজ নিয়ে খাবার পৌঁছে দেয়ার নির্দেশনা দেয়া আছে।
জেলা প্রশাসক আরো বলেন, পূর্বের নিয়মে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাহী যানবাহনগুলো লকডাউন এলাকায় এলাউ করা আছে। তাই প্রয়োজনীয় খাবারের যোগানে কোন সমস্যার সৃষ্টি হবে না।
লকডাউন এলাকা এবং আশপাশের হতদরিদ্রের খাদ্য সংস্থান বিষয়ে রামু সেনানিবাসের মিডিয়া সমন্বয়ক মেজর তানজিল বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক দিক নির্দেশনায় ‘আপনার সুস্থতাই আমাদের কাম্য’-এ প্রতিপাদ্যে সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের জন্য নির্ধারিত রেশনসামগ্রীর একাংশ বাঁচিয়ে প্রতিদিনই জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে খেটে খাওয়া, হতদরিদ্র, কর্মহীন মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী ও বীজ বিতরণ অব্যহত রয়েছে। পাশাপাশি ধারাবাহিক পরিচালনা করা হচ্ছে বিনামূল্যের ’সেনা বাজার’ও।
তিনি আরো বলেন, খাবার সহায়তার পাশাপাশি কক্সবাজারের অনেক জায়গায় সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল ক্যাম্প পরিচালনা করছে। সেনা চিকিৎসক, নার্সসহ সেনাসদস্যরা করোনা মোকাবেলায় নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। লকডাউন পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি মানুষের নানাবিধ সংকট দূর করতেই সেনাবাহিনী এ পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, কক্সবাজারে রোববার বিকেল পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। উপসর্গ নিয়ে ভোগছে আরো কয়েক হাজার। কক্সবাজার সদর হাসপাতাল এবং জেলার বাইরে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে মারা গেছেন সাংবাদিক-ব্যবসায়ী ও নানা পেশার ২৫ জনের অধিক।
বাংলাধারা/এফএস/টিএম/এএ













