১ ডিসেম্বর ২০২৫

করোনাকালে পর্যটন শিল্পের দুঃখ

মুহাম্মদ আব্দুল আলী »

প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্রের ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশ অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাই পর্যটন শিল্পের বিকাশেও আমাদের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বেই মন্দার সৃষ্টি হয়েছে। বৈশ্বিক পর্যটনও এ থেকে মুক্ত থাকেনি। বাংলাদেশের পর্যটনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মূলত করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের পর্যটনের সাথে সম্পৃক্ত সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে।

এই মাহামারিতে পর্যটন শিল্পে ব্যাপক ক্ষতির সাথে সাথে পর্যটনের সাথে জড়িত অনেকের কর্মসংস্থান পড়েছে হুমকির মুখে। বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস অনুসারে, করোনার প্রভাব থাকবে আরো প্রায় ১ থেকে ২ বছর। ফলে এই দীর্ঘ সময় পর্যটন শিল্পকে টিকে থাকতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে সুচিন্তিত ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ দরকার বলে মনে করা হচ্ছে।

করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ পাঁচ মাস বন্ধ থাকার পর গত ১৭ আগস্ট দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে সবকিছু। নতুন স্বাভাবিকতায় তাই ঘুরে দাঁড়ানোয় চেষ্টায় রয়েছে দেশের পর্যটন খাত সংশ্নিষ্টরা। আবার খুলছে হোটেল, মোটেলসহ পর্যটন স্পট। দর্শনার্থীও দিন দিন বাড়ছে। সংশ্নিষ্টদের আশা, নতুন কোনো সংকট তৈরি না হলে তারা করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে।

করোনার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পর্যটন খাতও অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। তবে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে সবকিছু। নতুন স্বাভাবিকতায় তাই ঘুরে দাঁড়ানোয় চেষ্টায় রয়েছে দেশের পর্যটন খাত সংশ্নিষ্টরা।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়- এ খাতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৪০ লাখ জনবল বেকার হয়ে পড়েছিল। পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়ায় আবার সবাই কর্মচঞ্চল হয়ে পড়েছে। ফলে পর্যটন নির্ভর অর্থনীতি আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। খুব দ্রæত পর্যটন খাত আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশাবাদ।

তবে অনেক আগেই টোয়াবের (ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) পক্ষ থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় ও ট্যুরিজম বোর্ডকে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ, কারণ এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও কর্মপরিকল্পনার সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

টোয়াবের সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবিকা নিয়ে সংকটে পড়েছেন ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, এয়ারলাইন্স, পর্যটক পরিবহন, ক্রুজিং, গাইডসহ এ খাত-সংশ্নিষ্ট অন্তত ৪০ লাখ পেশাজীবী। শুধু টোয়াবের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া হিসাব বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে প্রায় পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সার্বিকভাবে এই খাতে মোট ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ১২ হাজার কোটি টাকা। এ কারণে মহামারি কেটে গেলেও এর ধকল সামলে উঠতে পর্যটন খাতের অন্তত দুই বছর লেগে যেতে পারে। লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও সুরক্ষা সহযোগিতা জরুরি।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশের পর্যটন খাত বাঁচাতে ১৬ দফা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশও করা হয়েছিল টোয়াবের এই প্রতিবেদনে।

টোয়াব সভাপতি জাতীয় একটি পত্রিকায় বক্তব্য দিয়ে গিয়ে অভিযোগ করেন, প্রণোদনা প্যাকেজের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো অনিশ্চয়তায় থাকা পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে আগ্রহী হচ্ছে না। এ অবস্থায় টোয়াবের সুপারিশ অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা না নিলে পর্যটন খাত সংকট থেকে বের হতে পারবে না।

এদিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যটন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাই অভ্যন্তরীণ পর্যটন বিকাশের বড় সুযোগ এসেছে। এ ক্ষেত্রেই এখন বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

‘রিকভারি প্ল্যানের অংশ হিসেবে ৬৪টি জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত অনলাইন বৈঠক শুরু হয়েছে। বৈঠকে তিনি নিজেও যুক্ত থাকছেন। বৈঠকগুলোতে অভ্যন্তরীণ পর্যটনের সম্ভাবনা কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ জন্য প্রতি জেলায় ট্যুরিজম ইনফরমেশন সেন্টার স্থাপন, যেসব স্থানে পর্যটকরা যান সেগুলোকে আরও আকর্ষণীয় ও নিরাপদ করার ব্যবস্থা নেওয়া, নতুন ট্যুরিজম আকর্ষণ তৈরি করার কথা বলা হচ্ছে।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, রিকভারি প্ল্যানের পাশাপাশি পর্যটন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মহামারি সংকট মোকাবিলায় প্রধামনমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ, ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্সিসহ পর্যটন ব্যবসা-সংশ্নিষ্টরা সরকার ঘোষিত নিয়ম মেনে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা অন্যান্য খাতের ব্যবসায়ীরা যেভাবে নিচ্ছেন, পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদেরও একই প্রক্রিয়ায় সেই সুবিধা নিতে হবে। এক্ষেত্রে তারা সহায়তা চাইলে অবশ্যই দেওয়া হবে।

দেশে অসংখ্য নৈসর্গিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ধর্মীয় নিদর্শন ও স্থান রয়েছে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায় সমুদ্রকন্যা পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিচ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, যা বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি হিসেবে পরিচিত; হিমছড়ি ঝরনা, ইনানী সমুদ্রসৈকত, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, মহেশখালী, টেকনাফ, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, কাপ্তাই, বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকা, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার সিলেটের জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানিতে মাছের খেলা।

এছাড়া ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, কুমিল্লার ময়নামতি, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, ষাট গম্বুজ মসজিদ, আহসান মঞ্জিল ও কুষ্টিয়ার লালন শাহের আখড়া। রয়েছে ঐতিহাসিক কীর্তির ঐতিহাসিক স্থান, যেমন জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাতীয় শহীদ মিনার, জাতীয় কবির কবরস্থান, বাহাদুর শাহ পার্ক, রমনার বটমূল, কার্জন হল ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

দেশের সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ঘোষিত ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে এ বনের জীববৈচিত্র্য এটিকে পৃথিবীর অন্য যেকোনো পর্যটনকেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্ররূপে উপস্থাপন করেছে। সুন্দরবনকে বেষ্টন করে রেখেছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, খাল, শত শাখা নদী, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। বনভূমিটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানা ধরনের পাখি, হরিণ, কুমির, ডলফিন ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। তাই সুন্দরবন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে খুবই চমকপ্রদ ও আকর্ষণীয়।

দেশের পার্বত্য অঞ্চল পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হলো পাহাড়ে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি, যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। এখানে শীতে যেমন এক রূপ ধরা দেয় ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে, তেমনি বর্ষা অন্য এক রূপে হাজির হয়। শীতে পাহাড় কুয়াশা আর মেঘের চাদরে ঢাকা থাকে, তার সাথে থাকে সোনালি রোদের মিষ্টি আভা। আবার বর্ষায় চারদিকে জেগে ওঠে সবুজের সমারোহ।

মহামারি করোনার এই পরিস্থিতির মধ্যে আগামীকাল ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘পর্যটন ও গ্রামীণ উন্নয়ন’।

উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের পর্যটন শাখার বার্ষিক সম্মেলনের নাম, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। তখন থেকে এর নাম ‘বিশ্ব পর্যটন সংস্থা’ (ইউএনডব্লিউটিও) করার বিষয়ে সদস্যরা একমত হয়। নতুন নামে ১৯৭৪ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে সংস্থাটি।

১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উদযাপিত হচ্ছে। এর লক্ষ্য পর্যটনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পর্যটনের অবদান সম্পর্কে অবহিত করা।

বাংলাধারা/এফএস/এএ

আরও পড়ুন