২৪ অক্টোবর ২০২৫

উত্তাল কর্ণফুলী আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নের মুখে, সেনা মোতায়েন

কর্ণফুলী থানায় রক্তাক্ত ‘সমন্বয়ক’ পরিচয় দাতা সেলিম, অবরুদ্ধ বিএনপি নেতা সালা উদ্দিন

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার ডাঙারচরে হুমকির অভিযোগে দায়ের করা একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ঘিরে বৈঠক চলাকালে কথিত সমন্বয়ক মো. সেলিম রেজা (৩২) মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে বিএনপি নেতা মো. সালা উদ্দিন (৪৮) ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। পরে ওই ঘটনায় উল্টো সালা উদ্দিন কর্ণফুলী থানায় অবরুদ্ধ হন সেলিম রেজার অনুসারীদের তোপের মুখে।

ঘটনাটি ঘটে গত ৮ মার্চ বিকেলে ডাঙারচর নৌ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে। এরপর রাত সাড়ে ৯ টার দিকে এর রেশ গিয়ে পড়ে সিএমপির কর্ণফুলী থানায়। পুরো ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন কর্ণফুলী থানার ওসি মুহাম্মদ শরীফ ও নৌ তদন্ত কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত এএসআই আব্দুল হালিম।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জুলধা ইউনিয়নের ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশে সেলিম রেজার পৈতৃক সম্পত্তি অবস্থিত। ওই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সম্প্রতি তার সঙ্গে স্থানীয় বিএনপি নেতা সালা উদ্দিনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এই প্রেক্ষাপটে হুমকির অভিযোগ তুলে সেলিম রেজা বিএনপি নেতা সালা উদ্দিন ও অলি আহমদ কে অভিযুক্ত করে কর্ণফুলী থানায় একটি জিডি করেন। যার নম্বর ১০২৬।

জিডির তদন্ত কর্মকর্তা এএসআই আব্দুল হালিম দুই পক্ষকে আলোচনা করতে ডেকে আনেন তদন্ত কেন্দ্রে। আজ বিকেলে ওই বৈঠকে সেলিম রেজা তার দুই অনুসারীসহ উপস্থিত হন এবং বিএনপি নেতা সালা উদ্দিন আসেন তার ১৫-২০ জন নেতাকর্মী নিয়ে। একপর্যায়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি, মারধর ও হাতাহাতি শুরু হয়। এতে সেলিম রেজা গুরুতর আহত হন এবং তার পক্ষের একজন যুবকও আঘাত পান। অপরদিকে সালা উদ্দিন গ্রুপের জকির নামে একজনের পায়ে আঘাতের তথ্যও পাওয়া গেছে।

আহত অবস্থায় সেলিম রেজা পুলিশের সহায়তায় থানায় গেলে খানিক পরই সালা উদ্দিনও অভিযোগ জানাতে থানায় উপস্থিত হন। তখনই শুরু হয় দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ। সেলিম রেজার পক্ষের বেশ কয়েকজন যুবক থানায় প্রবেশ করে বিএনপি নেতা সালা উদ্দিনকে ঘিরে ফেলে, তাকে গালিগালাজ করে এবং প্রায় ৪০ মিনিট ধরে থানায় অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময় থানার সামনে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং শত শত লোকজন জড়ো হন।

পরিস্থিতি সামাল দিতে শিকলবাহা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো. মিজানুর রহমান দ্রুত থানায় পৌঁছে দুই পক্ষকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, থানার বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য এ সময় নিষ্ক্রিয় ছিলেন এবং সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়।

স্থানীয়ভাবে সেলিম রেজা পরিচিত ‘কথিত সমন্বয়ক’ হিসেবে। অতীতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে আছে বহু স্থিরচিত্র। তিনি বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা এবং আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু স্মৃতি সংসদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে তিনি নিজেকে ‘ছাত্র সমন্বয়ক’ পরিচয়ে পরিচিত করতে বেশি আগ্রহী।

অন্যদিকে, বিএনপির নেতাকর্মীদের দাবি, সেলিম রেজা আওয়ামী ঘরানার প্রভাবশালী একটি মহলের আশ্রয়ে থেকে পরিকল্পিতভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানি করছেন। ঘটনার পর রাতেই বিএনপির বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা থানার সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান দেন এবং সেলিম রেজার গ্রেপ্তার দাবি করেন।

এদিকে, পুরো ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি দেখে পরে সেনাবাহিনীর একটি টিম থানায় উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা এএসআই আব্দুল হালিম বলেন, ‘একটি জিডির আলোচনায় এভাবে বিশৃঙ্খলা হবে তা কল্পনাও করিনি। সালা উদ্দিনের পক্ষের লোকজন সেলিম রেজাকে মারধর করে এবং পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।’

সেলিম রেজার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তার একজন আত্মীয় জানান, তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এবং মাথায় ও হাতে লোহার রডের আঘাত পেয়েছেন।

অপরদিকে বিএনপি নেতা সালা উদ্দিন ফোন রিসিভ না করলেও, উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হাজী মো. ওসমান জানান, ‘ঘটনা সম্পর্কে আমরাও শুনেছি। বিস্তারিত জানতে হলে সালা উদ্দিনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে।’

নৌ তদন্ত কেন্দ্রের আইসি এসআই কেএম নাজিবুল ইসলাম তানভীরের কাছে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে পুরো ঘটনার বিষয়ে কর্ণফুলী থানার ওসি মুহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘আমি ওই সময় থানায় ছিলাম না, সিএমপির একটি মিটিংয়ে অংশ নিচ্ছিলাম। পরে খবর পেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

এদিকে, কর্ণফুলীর সচেতন মহল বলছে, দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিশোর গ্যাং, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি দিনদিন বেড়েই চলেছে। ওসি পরিবর্তনের পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি, বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

এএস/বাংলাধারা

আরও পড়ুন